রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণ আদায়ে কেন বিলম্ব

প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৪, ২২:০০

শাহীনূর ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

ঋণের মেয়াদ বেশি থাকা, ঘন ঘন পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন সুবিধাসহ বেশ কিছু কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ১০০ টাকার ঋণ ফেরত পেতে কমপক্ষে সাড়ে ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৮ বছর পর্যন্ত সময় লাগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পর্যালোচনায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিপরীতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সাধারণত গড়ে ১৫ মাসে তাদের বিতরণ করা ঋণ ফিরে পায়। আর বিদেশি ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণ ফিরে আসে ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে।
ব্যাংকাররা বলছেন, একই গ্রাহক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে যে আচরণ করেন, বিদেশি ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে তার আচরণ সম্পূর্ণ উল্টো। এই অসংগতি সমাধানের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় আরো স্বাধীনতা দরকার। নিয়মানুযায়ী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সুযোগ সম্প্রসারণ করা দরকার।
অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, মুনাফা করা রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মূল উদ্দেশ্য নয়। দেশের অর্থনীতি গতিশীল রাখা, সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখাই রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের মূল কাজ। ফলে এ ধরনের ব্যাংকগুলোতে মেয়াদি ঋণ যেমন রয়েছে, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে ঝুঁকিও বেশি নেয় এসব ব্যাংক। আমানতের মেয়াদ ও ধরন অনুযায়ী সবসময় বিনিয়োগ সম্ভব হয় না। যে কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর আদায়ের হার অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত ঋণ আদায়ের হার ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সর্বনিম্ন ৩.১৯ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৭.৮৭ শতাংশ। বিপরীতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এ ধরনের ঋণ আদায়ের হার গড়ে ২০ শতাংশ। আর বিদেশি ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত ঋণের ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে আদায়ের হার ৩৬ শতাংশ থেকে ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত। 
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, বর্তমানেও ঋণ আদায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং ২০২৩ সালে অনেক ঋণগ্রহীতাই পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের সুবিধা নিয়েছেন। এতে ঋণ পরিশোধের মেয়াদও লম্বা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গ্রাহক ও ঋণের ধরন, মেয়াদ, আসায়ের পরিকল্পনার কারণে অশ্রেণিকৃত ঋণ আদায়ের হার একেক ধরনের ব্যাংকের ক্ষেত্রে একেকরকম হচ্ছে। 
এতে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি, সম্পদের গুণগত মান ও মুনাফাও প্রভাবিত হচ্ছে। কারণ যেসব ব্যাংক দ্রুত বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত আনতে পারে, তাদের এসব সূচক তত উন্নত বা শক্তিশালী হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দেশের ব্যাংক খাতের ২০১৯ সালের জুন ত্রৈমাসিক থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর ত্রৈমাসিক পর্যন্ত সময়ের অশ্রেণিকৃত ঋণের আদায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, করোনা মহামারির সময়ে ঋণ পরিশোধে গ্রাহকরা বেশি সময় নিয়েছেন। তার রেশ এখনও কাটেনি। অনেক ক্ষেত্রেই করোনাপূর্ববর্তী সময়ে ফিরে যেতে পারেনি ব্যাংকগুলো। 

বিতরণকৃত ঋণের চিত্র
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে অশ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ১৪ লাখ ৭২ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। 
গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকÑ এই ছয় রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ১৩ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা অশ্রেণিকৃত ঋণ। বাকি ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। 
আর এই সময় পর্যন্ত ৪৩টি বেসরকারি ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৯৬ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭০ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। 
অন্যদিকে বিদেশি ৯টি ব্যাংকের গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ রয়েছে মাত্র ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ঋণের মেয়াদ যত লম্বা, ঝুঁকি তত বেশি। তবে স্বল্পমেয়াদি ঋণও খারাপ হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময় ঋণ আদায়ে জোর দিয়ে আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ে আগের তুলনায় তৎপর। রিকভারি টিম গঠন করছে ব্যাংকগুলো।
তিনি বলেন, ব্যাংক অবশ্যই ব্যবসা বাড়াবে। তবে সেজন্য আদায়ের পরিকল্পনাও সমানভাবে করতে হবে। যত দ্রুত অর্থায়ন করা অর্থ ফেরত আসবে, তত বেশি ঋণ দেয়ার ক্ষমতা বাড়বে। সম্পদের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। 
স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের সিইও নাসের এজাজ বিজয় বলেন, আমি অন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে মন্তব্য করব না। তবে অন্যান্য আন্তর্জাতিক ব্যাংকের মতোই এসসিবিও যে পদ্ধতিতে কাজ করে, তাতে কঠোর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া, স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ, ঋণ পরিশোধের একাধিক উৎসের মূল্যায়ন, বিতরণপরবর্তী কঠোর পর্যবেক্ষণ, ঝুঁকির অবস্থান পরিচালনা করার জন্য প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকে। এসব সম্মিলিত পদক্ষেপ আমাদের খেলাপি ঋণের অনুপাত যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে সহায়তা করে।
অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাসম-উল-ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অর্থায়নের ধরনের কারণে অর্থায়ন করা অর্থ ফেরত আসতে সময় লাগে। এ ধরনের ব্যাংক নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি, চলমান প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশি অর্থায়ন করে।
তিনি বলেন, এটাও সত্য, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক দেশের শিল্পায়নে ভূমিকা রাখছে। এসএমই খাতকে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করছে। তবে এখন সময় এসেছে ঋণ আদায়, গ্রাহকসেবা উন্নত করার। গ্রাহককে সময়মতো ঋণ ফেরত দেয়া নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে হবে। এজন্য জনবল ও দক্ষতার ঘাটতি দূর করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত