রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে বানভাসিরা

প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২২, ১৯:০২

দ্বীন অর্ণব
বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেট নগরবাসীর জনজীবন। ছবিটি শনিবার জালালাবাদ ইউনিয়ন থেকে তোলা

ভারতের মেঘালয় থেকে আসা পাহাড়ি ঢল আর প্রবল বৃষ্টিতে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দুই জেলা সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে এ অঞ্চলের মানুষেরা এখন লড়ছেন বাঁচার জন্য। সিলেট বিভাগের অধিকাংশ স্থান ইতঃমধ্যেই বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। নদ-নদী ও হাওরের পানি উপচে এই দুই জেলার অধিকাংশ একতলা বাড়িঘর ডুবে গেছে। জানা গেছে, এত অধিক পরিমাণ ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে যাওয়ায় অনেক বাসিন্দারা ঠাঁই পাচ্ছেন না আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে। এছাড়াও খাদ্য, সুপেয় পানি আর চিকিৎসাসামগ্রী দ্রুত পৌঁছানো না গেলে সেখানকার মানুষ আরও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে, এমন আশঙ্কা সবার। এদিকে পানির উচ্চতা বাড়ায় বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে দুই জেলা পুরোপুরি বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দুই জেলার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান নিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। তবে প্রয়োজনের তুলনায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা কম হওয়ায় সেখানেও থাকতে হচ্ছে মানবেতরভাবে। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক জফির সেতু বন্যাদুর্গত মানুষের সহযোগিতা করতে এলাকায় গিয়েছিলেন। এ সময় তিনি বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখেন। এ অভিজ্ঞতার কথা তিনি গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি বন্যাকবলিত সালুটিকর, খাগাইল, ছগাম, হুড়ারপাড়, ছামারাকান্দি, ফেদারগাঁও, বেতমুড়া, দীঘলবাঁকসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরেছি। পুরো উপজেলায় অমানবিক এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা।’

অন্তত ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দি: পাহাড়ি ঢল আর অতি ভারী বৃষ্টিতে নদনদী ও হাওরের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও বিস্তৃতি ঘটেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন দুই জেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। পানিবন্দি মানুষের মধ্যে হাহাকার ও আর্তনাদ চলছে। আশ্রয়ের খোঁজে পানি-স্রোত ভেঙে ছুটছে মানুষ। সবচেয়ে বিপদে আছেন শিশু ও বয়স্করা। আটকে পড়াদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে। যেখানেই শুকনো ও উঁচু জায়গা পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছেন মানুষ। সিলেটের সবকটি উপজেলা ও অর্ধেক শহর, সুনামগঞ্জের উপজেলা ও পৌর শহর বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক ও সিলেট-ভোলাগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবু রহমান মহাসড়ক। এখন পর্যন্ত অন্তত ৪০ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছে জানিয়ে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সিলেট বিভাগে বন্যা পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত আরও ভয়াবহ হচ্ছে। প্রবল বৃষ্টিপাতে নতুন নতুন উপজেলা প্লাবিত হচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম বাড়াচ্ছি।’

বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ও সংকট: সিলেটের অন্যতম বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র কুমারগাঁও স্টেশনে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে গেছে সিলেটের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। শনিবার (১৮ জুন) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। অন্যদিকে সুনামগঞ্জে গত দুই দিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় এসব এলাকার বাসিন্দাদের এখন মোমবাতির আলোতেই ভরসা। কিন্তু এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকায়ও মোমবাতির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বন্যার পানিতে কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে যাওয়ায় সেগুলো বন্ধ রয়েছে। এতে সংকট আরও বেড়েছে। সিলেট নগরের শাহজালাল উপশহর এলাকার বাসিন্দা সাব্বির আলম বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মোমবাতি কেনার ভোগান্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘শাহজালাল উপশহরের প্রায় সব কটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সোবহানীঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেও মোমবাতি পাইনি। অবশেষে হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজারের পাশে এসে মোমবাতি পেয়েছি।’

উদ্ধার তৎপরতা কার্যক্রম: সিলেটের ভয়াবহ বন্যায় উদ্ধার তৎপরতা ও মানবিক সহায়তায় একযোগে কাজ করছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস। শুক্রবার থেকে বন্যাকবলিত বিভিন্ন উপজেলায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছেন। পরে শনিবার থেকে নৌবাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধার তৎপরতায় যুক্ত হন। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর পাশাপাশি জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিলেটের সব ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে সবাইকে স্ট্যান্ডবাই ডিউটিতে রাখা হয়েছে। এর পর থেকে বন্যায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রম আরও জোরদার হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান সিকদার বলেন, ‘সিলেটের ভয়াবহ বন্যায় মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে ইতঃমধ্যে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তাদের নেতৃত্বে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও।’ এ ছাড়াও সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে যাচ্ছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের পাঁচটি রেসকিউ বোট ও একাধিক ডুবুরি দল।

আকাশপথ ও রেল যোগাযোগ বিপর্যয়: ইতঃমধ্যে বন্যায় তলিয়ে গেছে পুরো সিলেট। জেলার একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বন্যার পানি প্রবেশ করায় বন্ধ রয়েছে ফ্লাইট চলাচল। সিলেট বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বন্যার পানি বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি চলে আসা ছাড়াও বিমানবন্দরের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বন্যার পানি থেকে রক্ষার জন্য ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। অন্যদিকে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে যাবে না কোনো ট্রেন। সেই সঙ্গে সিলেট স্টেশনে কোনো ট্রেন আসবেও না। বন্যার কারণে বিভিন্ন জায়গায় রেল লাইন পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার কারণেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার নুরুল ইসলাম। 

ত্রাণ সহায়তা ও অনুদান: বানের পানির কারণে এই দুই জেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। খাদ্য সংকটেও পড়েছেন অনেকে। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় মানুষজন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিচ্ছেন। আটকাপড়াদের উদ্ধারে অভিযানে যোগ দিয়েছে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস। বন্যার্তদের সাহায্যে খাদ্যসামগ্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সহায়তায় এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা। বেসরকারি সংস্থার মধ্যে অন্যতম বিদ্যানন্দ। বিদ্যানন্দ সূত্রে জানা যায়, বন্যাদুর্গত সিলেট জেলায় তাদের চারটি টিম কাজ করছে। সেখানে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মধ্যে মূলত শুকনো ও রান্না করা খাবার বিতরণের কাজ করছে বিদ্যানন্দ। শুকনো খাবারের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে ১ কেজি মুড়ি, ৫০০ গ্রাম চিড়া ও গুড় দেওয়া হচ্ছে বলে জানায় সংস্থাটি। এছাড়াও বন্যা মোকাবিলায় ৫২ হাজার পরিবারকে জরুরি সহায়তা দিতে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে শুকনো খাবার, খাবার পানি, স্যালাইন, দিয়াশালাই, মোমবাতি, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও অন্যান্য সেবা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি বন্যায় আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতেও এ অর্থ ব্যয় করা হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঢালিউড সুপারস্টার শাকিব খান। এ সংকট মোকাবিলায় একটি তহবিল গঠনের মাধ্যমে তা থেকে প্রাপ্ত অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা পৌঁছে যাবে কষ্টে থাকা সেইসব মানুষের কাছে -এমনটাই বলছিলেন শাকিব।

বৃষ্টির পানির বড় অংশটি সুরমা-কুশিয়ারা নদী ব্যবস্থা দিয়ে এসে সিলেটে বন্যার সৃষ্টি করেছে, কিন্তু বৃষ্টির পানির আরেকটি অংশ ব্রহ্মপুত্র নদী ব্যবস্থা দিয়ে শনি-রবিবারের মধ্যেই বাংলাদেশে ঢুকবে এবং ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী ব্যবস্থা দিয়ে এসে নতুন এলাকায় বড় ধরনের বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। সিলেট বিভাগে বন্যার পাশাপাশি আগামী দুই দিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের ১৪টি জেলায়ও বন্যা হতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। তাই ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী ব্যবস্থায় থাকা জেলাগুলোয় এখন থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা এবং আশ্রয়কেন্দ্র চালুর আগাম প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই দুই নদী ব্যবস্থা দিয়ে আসা পানি অবশেষে পদ্মা-মেঘনা হয়ে সাগরে যাবে। তাই কিছুদিনের মধ্যে এই দুই নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোয়ও বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। আর যদি এই মেঘের একটি অংশ হিমালয়ে গঙ্গা নদীর উৎসে বৃষ্টি ঘটায়, তাহলে কয়েক দিনের মধ্যেই সেই পানি আসবে গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণকেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, নতুন করে বৃষ্টি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে। আরও নতুন এলাকা বন্যায় প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। জুনের চলতি সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশ ও উজানের অববাহিকাগুলোর স্থানসমূহে সামগ্রিকভাবে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে দেশের প্রধান নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকার কিছু জেলায় স্বল্পমেয়াদী থেকে মধ্যমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

সাহস২৪.কম/এআর/এএম/এসকে.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত