তিন কাশ্মীরি যুবকের ঘটনায় ভারতের ব্যাখ্যা চান জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা

প্রকাশ : ০১ জুন ২০২১, ২১:১৭

বিবিসি বাংলা

তিনজন কাশ্মীরি যুবকের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা ভারত সরকারের জবাবদিহিতা দাবি করেও কোনও সাড়া পাননি। প্রায় দু'মাস অপেক্ষা করার পর তাদের সেই চিঠি জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

ভারত-শাসিত কাশ্মীরের যে তিনজন যুবকের ঘটনা নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা ভারতের ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন, তাদের নাম ওয়াহিদ পারা, ইরফান আহমেদ দার ও নাসির আহমদ ওয়ানি।

এদের একজন রাজনীতিবিদ, যাকে মাসের পর মাস ধরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। একজন সামান্য দোকানদার, নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে যার মৃত্যু হয়েছে এবং তৃতীয়জন রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেছেন দু'বছর আগে।

কাশ্মীরের জেলে চরম নির্যাতনের শিকার ওয়াহিদ পারা

গত ৩১ মার্চ এই তিনটি ঘটনার উল্লেখ করে জাতিসংঘের ওই পাঁচজন বিশেষজ্ঞ ভারত সরকারের কাছে একটি চিঠি লেখেন এবং এ বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দেয়ারও দাবি জানান।

তারা ওই চিঠিতে লেখেন, "জম্মু ও কাশ্মীরে পুলিশ, সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে যে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে এই অভিযোগগুলো সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।"

তবে সেই চিঠি লেখার পর প্রায় দু'মাস কেটে গেলেও ভারত সরকারের কাছ থেকে তারা কোনও জবাব পাননি।

এরপর সেই চিঠিতে খুব সম্প্রতি জেনেভায় অবস্থিত জাতিসংঘের 'অফিস অব দ্য হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটসে'র (ওএইচসিএইচআর) ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে সর্বসমক্ষে আনা হয়েছে।

ওই চিঠিতে যারা সই করেছেন তাদের মধ্যে আছেন জাতিসংঘের নির্যাতন ও নিষ্ঠুর শাস্তি-বিরোধী স্পেশাল র‍্যাপোটিয়ের নিলস মেলজের এবং ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আর্বিট্রারি ডিটেনশনের ভাইস-চেয়ার এলিনা স্টেইনার্টে।

এছাড়া 'গুম' বা রহস্যজনক অন্তর্ধান বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের চেয়ার-র‍্যপোটিয়ের তি-আং বেক, বিচার-বহির্ভূত হত্যা-বিষয়ক স্পেশাল র‍্যাপোটিয়ের অ্যাগনেস কালামার্ড এবং আর একজন শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ফিওনুয়ালা নি আওলাইন-ও চিঠির অন্যতম স্বাক্ষরকারী ছিলেন।

এই বিশেষজ্ঞরা সকলেই জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের পক্ষ থেকে তাদের 'ম্যান্ডেট' পেয়েছেন এবং সেই এক্তিয়ারেই তারা এ বিষয়ে ভারত সরকারের ব্যাখ্যা বা কৈফিয়ত চেয়েছিলেন।

কিন্তু ওই তিনজন কাশ্মীরি যুবকের সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল, যাতে তারা ভারতের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে ওই চিঠি লিখেছিলেন?

বিশেষজ্ঞরা ওই চিঠিতে তাদের নিজস্ব সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনাগুলোর যে বিবরণ দিয়েছেন তা এরকম:

ওয়াহিদ পারা যেমন ছিলেন পিপলস ডেমোক্র্যোটিক পার্টির যুব শাখার সভাপতি। গত বছরের জুলাই মাসে তিনি জাতিসংঘের 'নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান ও ভাবী সদস্য দেশগুলোর' সাথে একটি ক্লোজড ভার্চুয়াল মিটিংয়ে অংশ নেন।

চিঠিতে অন্যতম স্বাক্ষরকারী অ্যাগনেস কালামার্ড

সেখানে তিনি জম্মু ও কাশ্মীরে ভারত সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করেন - এবং তার পরেই ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির গোয়েন্দারা এসে তাকে হুমকি দিয়ে যান সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুললে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত নভেম্বরে কাশ্মীরের স্থানীয় নির্বাচনে লড়ার জন্য মনোনয়ন দাখিল করার ঠিক তিনদিন পর ওয়াহিদ পারাকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।

বন্দীদশায় পারাকে মাটির তলায় একটি অন্ধকার সেলে হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রায় রাখা হয়েছিল। ঘুমোতে দেয়া হয়নি, লাথি-চড় মারা হয়েছে, রড দিয়ে প্রচন্ড মারধরও করা হয়েছিল।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা আরও লিখেছেন, পারা-কে নগ্ন করে উল্টো ঝুলিয়েও রাখা হয়েছিল বলে তারা জানতে পেরেছেন।

এ বছরের জানুয়ারিতে ওয়াহিদ পারা জামিন পেলেও মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে নতুন একটি চার্জে তাকে আবার আটক করা হয়। তিনি এখনও জেলেই আছেন।

তেইশ বছরের ইরফান আহমেদ দার পুলিশের হেফাজতে থাকাকালীন মারা যান গত বছরের সেপ্টেম্বরে।

তার মৃত্যুর ঠিক আগের দিন, উত্তর কাশ্মীরে রাজ্য পুলিশের স্পেশাল অপারেশনস গ্রুপ (এসওজি) সোপোরে এই দোকানদারের বাড়িতে এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়।

পরদিন তার পরিবারকে জানানো হয়, পুলিশের হাত থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় ইরফান নিহত হয়েছেন। সেই মৃত্যুর ম্যাজিস্টেরিয়াল তদন্ত চেয়ে তার পরিবার এখন হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন।

মাত্র ১৯-বছর বয়সী নাসির আহমদ ওয়ানির ঘটনাটি এগুলোর চেয়ে আরেকটু বেশি পুরনো।

চুয়াল্লিশ রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের সেনারা নাসিরের বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে মারতে মারতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল আজ থেকে প্রায় দু'বছর আগে।

অভিযোগ ছিল, নাসিরের মোবাইল ফোনটি না কি বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা ব্যবহার করছিল। নাসিরকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পরে তার আর কোনও খোঁজ মেলেনি।

সেনাবাহিনী তার পরিবারকে জানিয়েছে নাসিরকে না কি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নাসির আহমদ ওয়ানি কোনও দিনই আর নিজের বাড়িতে ফেরেনি।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এই তিনটি ঘটনায় যে নির্দিষ্ট আটটি বিষয় নিয়ে ভারত সরকারের বক্তব্য জানতে চেয়েছেন, তার একটি হল, 'মি নাসির আহমদ ওয়ানির কী পরিণতি হয়েছে এবং তিনি বর্তমানে কোথায় আছেন।'

তবে ভারত সরকার আজ পর্যন্ত এই আটটি বিষয়ের কোনওটি নিয়েই ব্যাখ্যা দেয়নি - কোনও জবাব দেয়নি ওই চিঠিরও।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত