সুকুমার রায়

প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:১৩

১৯২৩ সালে ১০ সেপ্টেম্বর সুকুমার রায় মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে একমাত্র পুত্র সত্যজিৎ রায় এবং স্ত্রীকে রেখে প্রয়াত হন। সুকুমার রায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়। সুকুমার রায় ভারতীয় সাহিত্যে "ননসেন্স রাইমের" প্রবর্তক। তিনি একাধারে লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার। আনন্দ কুড়ানোর উপাদানই ছিল তার লেখার বৈশিষ্ট। নিজের লেখায় কালি-কলমের আঁচড়ে চমৎকার সব কার্টুন ও ড্রয়িং ছিল তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। 

তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সন্তান। সুকুমার রায়ের পুত্র খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ রায় লেখালেখিতে পিতার মতই অলংকরণে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সত্যজিৎ তার লেখা ‘ফেলুদা’ ও ‘প্রফেসর শঙ্কু’ সিরিজের প্রায় সবকটি বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ নিজেই করেছিলেন। পিতার মতো তারও আঁকার মাধ্যম ছিল কালি-কলম। সত্যজিৎ রায় ভবিষ্যতে ভারতের অন্যতম একজন চলচ্চিত্র পরিচালকরূপে খ্যাতি অর্জন করেন ও নিজের মৃত্যুর ৫ বছর আগে ১৯৮৭ সালে সুকুমার রায়ের উপরে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা করেন।

সুকুমার রায়ের লেখা কবিতার বই আবোল তাবোল, গল্প হযবরল, গল্প সংকলন পাগলা দাশু, এবং নাটক চলচ্চিত্তচঞ্চরী বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা "ননসেন্স" ধরণের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়, কেবল অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড (Alice in Wonderland) ইত্যাদি কয়েকটি মুষ্টিমেয় ক্লাসিক-ই যাদের সমকক্ষ। মৃত্যুর বহু বছর পরেও তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম শিশুসাহিত্যিকদের একজন।

সুকুমার রায়ের মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। ১৮৮৭ সালে সুকুমার রায়ের জন্ম। সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায় তাঁর দুই ভাই। এ ছাড়াও তাঁর ছিল তিন বোন। ছোটবেলা থেকেই সুকুমারের প্রতিভার উন্মেষ লক্ষ্য করা যায়। তিনি গান গাইতেন, নাটক করতেন, কবিতা লিখতেন, মুখে মুখে তৈরি করে ফেলতেন নানা ধরণের ছড়া। সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। তাঁর পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যনুরাগী, যা তাঁর মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি সুকুমারকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন। এছাড়াও রায় পরিবারের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের সম্পর্ক ছিল।

পড়াশোনায় মেধাবী সুকুমার স্বাভাবিক ভাবেই ভাইবোনদের নেতৃত্ব দিতেন, গান ও মজাদার ছড়ায় বাড়ির সবাইকে মাতিয়ে তুলতেন। বোন পুণ্যলতার ভাষায় – “দাদা যেমন আমাদের খেলাধুলা ও সব কিছুরই পাণ্ডা ছিল, তেমনি বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের মধ্যেও সে সর্দার হল। ...... তার মধ্যে এমন কিছু বিশেষত্ব ছিল যার জন্য সবাই তাকে বেশ মানত। ...... বড়ররাও তার কথার বেশ মূল্য দিতেন।” খুড়তুতো বোন লীলা মজুমদার লিখেছেন তার ‘বড়দা’ সুকুমারের কথা – “চেহারার মধ্যে কি যেন একটা ছিল, যা তার সর্বাঙ্গ থেকে আলোর মত ঝরে পড়ত।”

সুকুমার রায় কলকাতার সিটি স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন। ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিতে ডাবল অনার্স নিয়ে ১৯০৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি. এস-সি পাশ করেন সুকুমার। কলেজে থাকতে গড়ে তোলেন ‘ননসেন্স ক্লাব’। তার শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত রসায়নবিদ প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ক্লাবের মুখপত্র ছিল হাতে লেখা কাগজ-‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ (৩২II ভাজা)। সুকুমারের খেয়াল রসাস্রিত লেখা প্রথম ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’র পাতাতেই বেরিয়েছিল। ননসেন্স ক্লাবের সভ্যদের নিয়ে অভিনয় করার জন্য দু’টি নাটক লিখেছিলেন সুকুমার – ‘ঝালাপালা’ ও ‘লক্ষণের শক্তিশেল’।

‘ঝালাপালা’তেই রয়েছে তার সেই বিখ্যাত রসসৃষ্টি – 
“পণ্ডিত। বটে! তোর বাড়ি কদ্দুর ?
কেষ্টা। আজ্ঞে, ওই তালতলায় – ‘আই গো আপ, ইউ গো ডাউন-’ মানে কি ?
পণ্ডিত। ‘আই’ - ‘আই’ কিনা চক্ষুঃ, ‘গো’ - গয়ে ওকার গো - গৌ গাবৌ গাবঃ, ইত্যমরঃ, ‘আপ’ কিনা আপঃ সলিলং বারি অর্থাৎ জল - গরুর চক্ষে জল - অর্থাৎ কিনা গরু কাঁদিতেছে - কেন কাঁদিতেছে - না উই গো ডাউন, কিনা ‘উই’ যাকে বলে উইপোকা - ‘গো ডাউন’, অর্থাৎ গুদোমখানা - গুদোমঘরে উই ধরে আর কিছু রাখলে না - তাই না দেখে, ‘আই গো আপ’ – গরু কেবলই কাঁদিতেছে -”

‘ননসেন্স ক্লাবে’র নাটক দেখার জন্য ছেলেবুড়ো সকলেই ভিড় জমাতো। পুণ্যলতা লিখেছেন –“বাঁধা স্টেজ নেই, সীন নেই, সাজসজ্জা ও মেকআপ বিশেষ কিছুই নেই, শুধু কথা সুরে ভাবে ভঙ্গিতেই তাদের অভিনয়ের বাহাদুরি ফুটে উঠত, দাদা নাটক লিখত, অভিনয় শেখাত। ... হাঁদারামের অভিনয় করতে দাদার জুড়ি কেউ ছিল না। অভিনয় করতে ওরা নিজেরা যেমন আমোদ পেত, তেমনি সবাইকে আমোদে মাতিয়ে তুলত। চারিদিকে উচ্ছ্বসিত হাসির স্রোত বইয়ে দিত। ...... ননসেন্স ক্লাবের অভিনয় দেখার জন্য সবাই উৎসুক হয়ে থাকত।”

উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন, এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ. রয় এন্ড সন্স নামে ঐ প্রতিষ্ঠানের সাথে সুকুমার যুক্ত ছিলেন ; প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি.(অনার্স) করার পর সুকুমার মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিলেতে যান। উপেন্দ্রকিশোর নিজে বিলেতে না গেলেও পুত্র সুকুমার বিদেশে গিয়ে মুদ্রণ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করুক এ বাসনা তার ছিল ।

১৯১১ সালের অক্টোবর মাসে ২৩ বছর বয়সে গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি নিয়ে সুকুমার বিলেতে যান। প্রথমে লন্ডনে এক বছর County Council School of Photoengraving and Lithography-তে পড়াশোনা করে পরে ম্যানচেস্টারে Municipal School of Technology-তে chromolithography and litho-drawing সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করেন। বিলেত থেকে সুকুমার বাবাকে যেসব চিঠি লিখেছেন তাতে তার কাজের বিস্তৃত বিবরণ মেলে। বিলেতে শেষ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে bronze পদক লাভ করেন সুকুমার। তার গবেষণা-পত্র Penrose’s Pictorial Annual এবং The British Journal of Photography পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯১৩ সালে সুকুমার কলকাতাতে ফিরে আসেন। ১৯২২ সালে তিনি দ্বিতীয় ভারতীয় হিসাবে Royal Photographic Society-এর সদস্য নির্বাচিত হন।

সুকুমার ইংল্যান্ডে পড়াকালীন, উপেন্দ্রকিশোর জমি ক্রয় করে, উন্নত-মানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন। তিনি ছোটদের একটি মাসিক পত্রিকা, 'সন্দেশ', এই সময় প্রকাশনা শুরু করেন। সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। উপেন্দ্রকিশোর জীবিত থাকতে সুকুমার লেখার সংখ্যা কম থাকলেও উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব সুকুমার নিজের কাঁধে তুলে নেন। শুরু হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। পিতার মৃত্যুর পর আট বছর ধরে তিনি সন্দেশ ও পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ছোটভাই এই কাজে তাঁর সহায়ক ছিলেন এবং পরিবারের অনেক সদস্য 'সন্দেশ'-এর জন্য নানাবিধ রচনা করে তাঁদের পাশে দাড়ান।

সুকুমার রায়ের স্বল্পস্থায়ী জীবনে তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। সন্দেশের সম্পাদক থাকাকালীন তাঁর লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তাঁর অসাধারণ ননসেন্স ছড়াগুলোতে। তাঁর প্রথম ও একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই আবোল তাবোল শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার।

ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতাও দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তখনও নোবেল পুরস্কার পাননি। ইতিমধ্যে সুকুমার লেখচিত্রী/প্রচ্ছদশিল্পীরূপেও সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রযুক্তিবিদের পরিচয় মেলে, নতুন পদ্ধতিতে হাফটোন ব্লক তৈরি আর ইংল্যান্ডের কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রযুক্তি বিষয়ক রচনাগুলো থেকে। সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের মন্দিরে একটি প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন। 

আচার্যের ভাষণে তিনি বলেন –“আমার পরম স্নেহভাজন যুবকবন্ধু সুকুমার রায়ের রোগশয্যার পাশে এসে যখন বসেছি, এই কথাই বার বার মনে হয়েছে, জীব-লোকের ঊর্ধ্বে আধ্যাত্মলোক আছে। যে-কোন মানুষ এই কথাটি নিঃসংশয়ে বিশ্বাসের দ্বারা নিজের জীবনে স্পষ্ট করে তোলেন, অমৃতধামের তীর্থযাত্রায় তিনি আমাদের নেতা। আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি, কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো অল্পকালের আয়ু নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে আর কাউকে দেখি নি। মৃত্যুর দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে অসীম জীবনের জয়গান তিনি গাইলেন। তাঁর রোগশয্যার পাশে বসে সে গানের সুরটিতে আমার চিত্ত পূর্ণ হয়েছে।”

ইংল্যান্ডে একটি সভায় রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে The spirit of Rabindranath Tagore নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন সুকুমার। ১৯১৩ সালের ২১ শে জুলাই প্রবন্ধটি তিনি পাঠ করেছিলেন East and West Society-তে। আমেরিকায় ছ’মাস কাটিয়ে লন্ডনে ফিরে অর্শ রোগের চিকিৎসার জন্য রবীন্দ্রনাথ তখন একটি নার্সিং হোমে ভর্তি। দু’সপ্তাহ সেখানে ছিলেন তিনি। নার্সিং হোমে কবিকে দেখতে যেতেন সুকুমার। পঠিত প্রবন্ধটির মাধ্যমে বিলেতে অনেক বিদ্বজ্জনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “ইহাই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ভারতীয়দের পক্ষে প্রথম পাবলিক ভাষণ।” প্রবন্ধটি বিখ্যাত পত্রিকা Quest-এ প্রকাশিত হয়।

১৯১৩ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ‘সিটি অব লাহোর’ নামক জাহাজে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন সুকুমার, সঙ্গে ছিলেন কালীমোহন ঘোষ। অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন –“কুড়ি দিনের এই দীর্ঘ পথে কবির সঙ্গে সুকুমারের কি কি বিষয়ে আলাপ হয়েছিল, কেমন কেটেছিল কবিসঙ্গ, তার কোন লিপিবদ্ধ বিবরণ মেলে নি। সত্যজিৎ রায়কে এই প্রসঙ্গে পরে যখন জিজ্ঞাসা করি, তিনি বলেন “আপশোসের কথা, শৈশবে বাড়ি বদলের সময় বাবা ও ঠাকুরদার অনেক কাগজপত্র হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়াটা আমাদের সকলের পক্ষেই দুর্ভাগ্য। থাকলে হয়ত আরও অনেক কিছুই জানা যেত।”

বিলেত থেকে ফেরার দু’মাস পরেই সুকুমারের বিয়ে হয় কে. জি. গুপ্তর ভাগ্নি এবং সরলা ও জগৎচন্দ্র দাশের মেজ মেয়ে সুগায়িকা সুপ্রভার সঙ্গে। সুপ্রভার ডাক নাম ছিল টুলু। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বড় মেয়ে শান্তা দেবীর কথায় –“সুকুমারবাবু বিবাহ করেন আমার সহপাঠিনী এবং বন্ধু টুলুকে। তারপর ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝে চায়ের নিমন্ত্রণে যেতাম।” সুপ্রভা ও শান্তা একই সঙ্গে বেথুন স্কুল ও কলেজে পড়তেন। 

বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। কিন্তু কবি চিঠি দিয়ে জানান শিলাইদহে জমিদারীর কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। বিয়েতে আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলেন সীতা দেবী। তিনি তার ‘পুণ্যস্মৃতি’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন –“ ১৯১৩-র ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি বোধ হয় সুকুমার রায়ের বিবাহ হয়। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে ছিলেন শুনিয়াছিলাম। বিবাহ প্রায় আরম্ভ হইতে যাইতেছে এমন সময় গেটের কাছে করতালিধ্বনি শুনিয়া কিছু বিস্মিত হইয়া গেলাম। পরক্ষণেই দেখিলাম কবি আসিয়া সভাস্থলে প্রবেশ করিলেন। পরে শুনিয়াছিলাম, এই বিবাহে উপস্থিত থাকিবার জন্যই তিনি কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। সুকুমারবাবুকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করিতেন।”

বিয়ের পরে সুপ্রভাকে সঙ্গে নিয়ে সুকুমার শিলং-এ এলেন। সেখানে তার কাকা প্রমদারঞ্জন তার স্ত্রী সুরমা ও মেয়ে লীলাকে নিয়ে থাকতেন। রামকুমার বিদ্যারত্নের (‘হিমারণ্য’ গ্রন্থের লেখক) মেয়ে সুরমা মানুষ হয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারে। লীলা মজুমদার মা’র কাছে ‘তাতা’ অর্থাৎ সুকুমারের নাম শুনেছেন কিন্তু কখনও চোখে দেখেন নি। তিনি বড়দা (সুকুমার) সম্বন্ধে লিখেছেন –“লম্বা দোহারা মানুষটি। একমাথা কালো কোঁকড়া চুল। চোখ দুটি প্রায় সব সময় হাসত। কিন্তু গম্ভীর হলে এমন গম্ভীর হত যে কাছে ঘেঁষতে ভয় পেতাম। বড়দা ছিল যেমন আমুদে তেমনি রাশভারী। অন্যায় সে কখনো সইত না। যতদূর মনে পড়ে বড়দার বাঁ-গালে একটা বড় তিল ছিল, আমাদের সেটিকে ভারি পছন্দ ছিল।” সুপ্রভা বৌঠানকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা –“তখন বিকেল বেলা। পড়ন্ত রোদে বৌঠানকে বড় সুন্দর দেখাচ্ছিল। পড়নে ঢাকাই শাড়ি। গলায় লম্বা মটরমালা, শ্যামলা রঙের উপর অমন সুন্দর মুখ কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।”

সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্য ছাড়াও সুকুমার ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠির এক তরুণ নেতা। ব্রাহ্ম সমাজ, রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী, অদ্বৈতে বিশ্বাসী হিন্দুধর্মের এক শাখা যারা ৭ম শতকের অদ্বৈতবাদী হিন্দু পুরান ঈশ-উপনিষদ মতাদর্শে বিশ্বাসী। সুকুমার রায় 'অতীতের কথা' নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন, যা ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাসকে সরল ভাষায় ব্যক্ত করে - ছোটদের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের মতাদর্শের উপস্থপনা করার লক্ষে এই কাব্যটি একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করা হয়।

‘সন্দেশ' পত্রিকা উপেন্দ্রকিশোরের এক অনবদ্য সৃষ্টি। ছোটদের এরকম সর্বাঙ্গসুন্দর পত্রিকা আর হয়েছে কিনা সন্দেহ। ১৯১৩ সালের মে মাসে (বৈশাখ, ১৩২০) ‘সন্দেশে’র প্রথম সংখ্যা যখন প্রকাশিত হয় সুকুমার তখন মুদ্রণ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিলেতে রয়েছেন। উপেন্দ্রকিশোর একই সঙ্গে লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন, প্রুফ দেখেছেন ও ছাপাখানার কাজ দেখাশোনা করেছেন। এর কয়েকমাস পরেই দেশে ফিরে সুকুমার পুরোপুরি পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন সুকুমার। ১৯২৩ সালের ১০ই ডিসেম্বর তার অকাল মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মোট তেত্রিশটি সংখ্যা সম্পাদনা করে গেছেন উপেন্দ্রকিশোর। সুকুমারের পর ভাই সুবিনয় রায়ের সম্পাদনায় ‘সন্দেশ’ চলেছিল দু’বছর। সব মিলিয়ে প্রথম পর্যায়ের ’সন্দেশ’ বারো বছরের সামান্য বেশি চলেছিল। বারো বছরের মধ্যে সুকুমার সম্পাদক ছিলেন আট বছর। ‘সন্দেশ’ তাই সুকুমারময়।

সুকুমারের পরিবারের অনেকেই পত্রিকায় লিখেছেন। কাকা কুলদারঞ্জন ছোটদের প্রিয় হয়েছিলেন ‘রবিনহুড’ লিখে। ছোটকাকা প্রমদারঞ্জন কর্মজীবনে সার্ভে অব ইন্ডিয়ার কাজে ব্রহ্মদেশ সীমান্তের দুর্গম অঞ্চলে ভ্রমণের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ধারাবাহিক ভাবে ছোটদের পরিবেশন করেছেন ‘বনের খবর’ নামক সত্যি ঘটনায়। ছোটদের বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়েছিল ঘটনার সত্যতা। বড়দিদি সুখলতা, মেজদিদি পুণ্যলতা গল্প ও কবিতা লিখেছেন। মেজভাই সুবিনয় ছিলেন হেঁয়ালি ও ধাঁধা রচনায় সিদ্ধহস্ত। ছোটভাই সুবিমল ও ছোটবোন স্বল্পায়ু শান্তিলতাও কলম ধরেছেন ‘সন্দেশে’র জন্য। প্রমদারঞ্জনের মেয়ে লীলা রায় (পরে যিনি লীলা মজুমদার নামে খ্যাত) এই পত্রিকায় লিখেই হাত পাকিয়েছেন।

সুকুমারের আট বছরের সম্পাদনা কালের মধ্যে শেষ আড়াই বছরই কেটেছে রোগশয্যায়। বিছানায় শুয়ে বসেই তিনি লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন, প্রুফ দেখেছেন। কোন কোন সংখ্যায় তার সাত আটটা লেখাও বেরিয়েছে। তবে ‘সন্দেশ’ শুধু পারিবারিক পত্রিকা হয়ে থাকে নি। এতে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রী, কালিদাস রায়, কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ রায়, সীতা দেবী, শান্তা দেবী, প্রিয়ম্বদা দেবী, কামিনী রায়, কাজি নজরুল ইসলাম, অসিতকুমার হালদার, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, অবনীন্দ্র-দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকেরা। সুনির্মল বসুকে পরিণত হতে সাহায্য করেছে ‘সন্দেশ’ পত্রিকা। এদের রচনা যোগাড় করতে সুকুমারকে নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত ভাবে যোগাযোগ করতে হয়েছে।

‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক হবার আগেই সুকুমারের কিছু প্রবন্ধ ও দুটি নাটক -‘শব্দকল্পদ্রুম’ ও ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’ প্রকাশিত হয়েছে। ‘প্রবাসী’-তে লেখা এসব রচনা ঠিক ছোটদের জন্য নয়। ‘নাটক দুটি প্রধানত আইডিয়ার আধার। ... এর উপভোগ্যতার প্রধান কারণ হল এর শাণিত কমিক সংলাপ। সুকুমারের ... মজলিসি মেজাজের ষোল আনা পরিচয় মেলে এ দুটি নাটকে।’

বিদেশে থাকার জন্য প্রথম দিকে প্রকাশিত সংখ্যাগুলিতে সুকুমারের লেখা তেমন বেরোয় নি। তার প্রথম আবির্ভাব ১৩২০’র শ্রাবণ সংখ্যায় কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়ের গল্প ‘ভবম হাজাম’-এর চিত্রকর রূপে। এটি তিনি পাঠিয়েছিলেন বিলেত থেকে। রবীন্দ্রনাথও তখন সেখানে। বিলেতে বসেই কবির হাতে ‘সন্দেশে’র প্রথম সংখ্যাটি তুলে দিয়েছিলেন সুকুমার। খুব খুশি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং কথা দিয়েছিলেন সময় পেলেই ‘সন্দেশে’র জন্য তিনি লিখবেন। সুকুমার বিলেত থেকে বাবা উপেন্দ্রকিশোরকে চিঠি লিখে একথা জানিয়েছিলেন।

‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক হবার আগেই সুকুমারের কিছু প্রবন্ধ ও দুটি নাটক-‘শব্দকল্পদ্রুম’ ও ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’ প্রকাশিত হয়েছে। ‘প্রবাসী’-তে লেখা এসব রচনা ঠিক ছোটদের জন্য নয়। ‘নাটক দুটি প্রধানত আইডিয়ার আধার। ... এর উপভোগ্যতার প্রধান কারণ হল এর শাণিত কমিক সংলাপ। সুকুমারের ... মজলিসি মেজাজের ষোল আনা পরিচয় মেলে এ দুটি নাটকে।’

সুকুমারের আট বছর বয়সে ‘নদী’ নামে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘মুকুল পত্রিকার ১৩০২ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। পরের বছর ১৩০৩ জ্যৈষ্ঠেই এই পত্রিকায় বেরিয়েছে বিখ্যাত Hickory Dickory Dock অবলম্বনে তার কবিতা ‘টিক-টিক-টং’। (প্রসঙ্গত, ‘অবসরে’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘পুরানো সাময়িক পত্রিকায়’ ‘মুকুল’ পত্রিকা প্রসঙ্গে সুকুমারের ‘নদী’ কবিতাটি উদ্ধৃত হয়েছে)। ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা দু’টি ছিল ‘বেজায় রাগ’ (১৩২০, অগ্রহায়ণ) ও ‘খোকা ঘুমায়’ (১৩২০ পৌষ)। বিলেত থেকে দেশে ফিরে আসার পর ‘সন্দেশে’ তার উদ্ভট কবিতার প্রথম প্রকাশ ‘খিচুড়ি’ নামক কবিতায় (মাঘ ১৩২১)। কবিতার নামে না চিনলেও রচনাটি নিশ্চয়ই অনেকেরই পরিচিত –
“হাঁস ছিল সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)

হয়ে গেল হাঁসজারু কেমনে তা জানি না।” ...... ইত্যাদি। কবিতার সঙ্গে ছিল ‘হাঁসজারু’, ‘বকচ্ছপ’, ‘বিছাগল’, ‘গিরিগিটিয়া’ প্রভৃতি সন্ধিযুক্ত কল্পিত প্রাণীর বিচিত্র সব ছবির সমাহার। তার ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের সব কবিতাই ‘সন্দেশে’ ছাপা হয়েছে, তবে অনেক সময়ে ভিন্ন নামে। যেমন, ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ (‘সন্দেশ’র নাম ‘বাপরে’, আষাঢ়, ১৩২৮), ‘রামগরুরের ছানা’ (‘সন্দেশে’র নাম ‘হেস’ না!’, বৈশাখ, ১৩২৫), ‘নোটবই’ (‘সন্দেশে’র নাম ‘জিজ্ঞাসু’, বৈশাখ, ১৩২৭) ইত্যাদি। 

পত্রিকায় ‘আবোল তাবোল’ নাম দিয়ে বেরিয়েছে তার বিখ্যাত কবিতা ‘খুড়োর কল’, ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম’, ‘গানের গুঁতো’ প্রভৃতি। সুকুমার বেঁচে থাকতে তার তিনটি নাটক ‘সন্দেশে’ প্রকাশিত হয়েছিল –‘অবাক জলপান’, ‘হিংসুটে’ ও ‘মামা গো’। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে ‘ঝালাপালা’ ও ‘লক্ষণের শক্তিশেল’। অতুলনীয় ‘হ-য-ব-র-ল’ বেরিয়েছে ১৩২৯-এর জ্যৈষ্ঠ থেকে পরপর চারটি সংখ্যায়। ‘পাগলা দাশু’র কুড়িটি গল্পই ‘সন্দেশে’ ছাপা হয়েছে। ‘বহুরূপী’ ও আরও কয়েকটি গল্প বেরিয়েছে এই পত্রিকায়। ‘খাইখাই’-এর বিভিন্ন কবিতাও প্রথমে ছোটদের হাতে এসেছে ‘সন্দেশে’র মাধ্যমেই। ‘হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’ প্রকাশিত হয়েছে ১৩২৯ সালের বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। এটি পড়ে পরবর্তী কালে সত্যজিতের লেখা প্রফেসর শঙ্কুর কথা মনে পড়ে যায়।

দুঃখের কথা ‘আবোল তাবোল’ পুস্তকটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩-এর ১৯শে সেপ্টেম্বর, সুকুমারের মৃত্যুর ন’দিন পরে। অন্যান্য বই বেরিয়েছে অনেক পরে। ‘পাগলা দাশু’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৪০-এর ২২শে নভেম্বর, এম. সি. সরকার এন্ড সন্স থেকে। সিগনেট প্রেস থেকে ‘বহুরূপী’র প্রকাশ ১৯৪৪ সালে। ‘পাগলা দাশু’ প্রকাশের সময় সুপ্রভা রায় রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন একটি ‘ভূমিকা’ লিখে দিতে। কালিম্পঙ থেকে ১৯৪০-এর ১লা জুন তারিখে লেখা ‘ভূমিকা’টি ছিল – “সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছন্দ গতি, তার ভাব সমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে। তাঁর স্বভাবে মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল, সেই জন্যই তিনি তাঁর বৈপরীত্য এমন খেলাচ্ছলে দেখাতে পেরেছিলেন। 

বঙ্গসাহিত্যে ব্যঙ্গ রসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরো কয়েকটি দেখা গিয়েছে কিন্তু সুকুমারের অজস্র হাস্যোচ্ছ্বাসের বিশেষত্ব তাঁর প্রতিভার যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে তার ঠিক সমশ্রেণীর রচনা দেখা যায় না। তাঁর এই বিশুদ্ধ হাসির দানের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অকাল মৃত্যুর সকরুণতা পাঠকদের মনে চিরকালের জন্য জড়িত হয়ে রইল।” এই মুদ্রণটি এখন দুষ্প্রাপ্য। পরবর্তী সিগনেট প্রেসের সংস্করণে রবীন্দ্রনাথের ‘ভূমিকা’টি বর্জিত হয়েছে।

‘দ্রিঘাংচু’ নামে সুকুমারের একটি গল্প বেরোয় ‘সন্দেশে’র ১৩২৩-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায়। সত্যজিৎ রায় লিখেছেন –“সুকুমার সম্পাদক হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই একটি ছোট গল্প সন্দেশে বেরোয় যেটি আমার মতে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। গল্পের নাম ‘দ্রিঘাংচু’। এক রাজসভায় অকস্মাৎ একটি দাঁড়কাক প্রবেশ করে গম্ভীর কণ্ঠে ‘কঃ’ শব্দটি উচ্চারণ করার ফলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তাই নিয়েই গল্প। গল্পের শেষে রাজামশাইকে রাজপ্রাসাদের ছাতে একটি দাঁড়কাকের সামনে দাঁড়িয়ে চার লাইনের একটি মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়। মন্ত্রটি হ’ল –
“হলদে সবুজ ওরাং ওটাং
ইঁট পাটকেল চিৎ পটাং
গন্ধ গোকুল হিজিবিজি
নো অ্যাডমিশন ভেরি বিজি...”

“খাঁটি ননসেন্সের এর চেয়ে সার্থক উদাহরণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।” এটি সত্যজিৎ তার একটি ছায়াছবিতেও ব্যবহার করেছেন।

প্যারোডি রচনাতেও সুকুমার ছিলেন সিদ্ধহস্ত। শান্তিনিকেতনে গিয়ে রান্নায় আলু খেতে খেতে, রবীন্দ্রনাথের ‘এই ত ভাল লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়’ গানের অনুকরণে নিজেই গেয়ে ওঠেন ‘এইতো ভাল লেগেছিল আলুর নাচন হাতায় হাতায় ...’।

সুকুমার ভাষা, শব্দ, এদের ব্যবহার ও প্রকৃত অর্থ নিয়ে যেভাবে ভেবেছেন তার সাক্ষাৎ মেলে তার ‘ভাষার অত্যাচার’ নামক প্রবন্ধে। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রবাসী’র ১৩২২-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। অপর একটি রচনা শব্দ-ঝঙ্কার সমৃদ্ধ অনুপ্রাসকেন্দ্রিক কবিতা ‘বর্ণমালাতত্ত্ব’ পড়লে এ ধরণের রচনায় সুকুমারের অনায়াস এবং অসাধারণ দক্ষতা সহজেই চোখে পড়ে। কয়েকটি পংক্তি –
“অকূল আঁধারে কুহকপাথারে কে আমি একেলা কবি
হেরি একাকার সকল আকার সকলি আপন ছবি ।
কহে, কই কে গো, কোথায় কবে গো, কেন বা কাহারে ডাকি?
কহে কহ-কহ, কেন অহরহ, কালের কবলে থাকি?
কহে কানে কানে করুণ কুজনে কলকল কত ভাষে,
কহে কোলাহলে কলহ কুহরে কাষ্ঠ কঠোর হাসে।”

উপেন্দ্রকিশোরের ‘সন্দেশে’র সঙ্গে সুকুমারের ‘সন্দেশে’র একটা পার্থক্য সত্যজিতের চোখে পড়েছে, সেটি হ’ল –“বাবার সন্দেশের চেহারাটা ঠাকুর্দার সন্দেশের থেকে আলাদা হয়ে গেল। শিশুদের পত্রিকা থেকে হঠাৎই কিশোরদের পত্রিকা হয়ে উঠল।” ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় একটা বড় অংশ ছিল এর ছবি বা ‘ইলাস্ট্রেশন’। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ লিখেছেন –“উপেন্দ্রকিশোর বা সুকুমার কেউই আঁকা শেখেন নি। উপেন্দ্রকিশোরের কাজ দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু সুকুমারের কাজে বোঝা যায়। নিছক অঙ্কনকৌশলে সুকুমার উপেন্দ্রকিশোরের সমকক্ষ ছিলেন না। কিন্তু এই কৌশলের অভাব তিমি পূরণ করেছিলেন দুটি দুর্লভ গুণের সাহায্যে। এক হল তাঁর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, আর এক হল অফুরন্ত কল্পনাশক্তি। এই দুইয়ের সমন্বয়ে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু টেকনিককে অতিক্রম করে চোখের সামনে জলজ্যান্ত রূপ ধারণ করে।”

সমালোচকদের মতে সুকুমার পৌরাণিক ও অনুবাদ গল্পে তার পিতা উপেন্দ্রকিশোর ও খুল্লতাত কুলদারঞ্জনের মত স্বচ্ছন্দ ও সফল নন। ব্যতিক্রম হিসাবে উল্লেখিত হয়েছে ‘খৃষ্টবাহন’ ও ‘ভাঙাতারা’ গল্প দুটি।

‘সন্দেশে’ সুকুমারের অপর একটি অবদান ছিল তার বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাগুলি। ছোটদের উপযোগী করে সহজ ভাবে তিনি বিজ্ঞানের জটিল বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন অজস্র রচনার মাধ্যমে। নিজে বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র হওয়ায় এ কাজটা তিনি অনায়াসে সাবলীল ভঙ্গীতে করতে পেরেছেন। এ বিষয়ে তার প্রথম লেখা প্রবন্ধ ‘সূক্ষ্ম হিসাব’। ১৩২৫ কার্ত্তিক সংখ্যায় লিখেছেন ‘বেগের কথা’। কত সহজ ভাবে ছোটদের তিনি উপমা সহকারে ‘বেগ’ ও ‘বল’ সম্বন্ধে বুঝিয়েছেন তার সামান্য উদাহরণ –“তাল গাছের উপর হইতে ভাদ্র মাসের তাল যদি ধুপ করিয়া পিঠে পড়ে তবে তার আঘাতটা খুবই সাংঘাতিক হয়; কিন্তু ঐ তালটাই যদি তাল গাছ হইতে না পড়িয়া ঐ পেয়ারা গাছ হইতে এক হাত নীচে তোমার পিঠের উপর পড়িত, তাহা হইলে এতটা চোট লাগিত না। কেন লাগিত না? কারণ, বেগ কম হইত। কোন জিনিস যখন উপর হইতে পড়িতে থাকে তখন সে যতই পড়ে ততই তার বেগ বাড়িয়া চলে। ......”। বেতার যন্ত্র বোঝাতে ‘আকাশবাণীর কল’ যখন লিখেছেন, আমাদের দূরশ্রবণ ‘আকাশবাণী’র তখন সৃষ্টিই হয় নি। ‘আকাশবাণী’ নামটা কি সুকুমারের কাছ থেকেই পাওয়া?

সুকুমার তার ‘ননসেন্স’ ও উদ্ভট ধরণের রচনায় এডওয়ার্ড লিয়রের (Edward Lear, 1812-1888) ‘A Book of Nonsense’, লুইস ক্যারলের (Lewis Carroll, 1832-1898 ) ‘Alices Adventure in Wonderland’ প্রভৃতি লেখার দ্বারা নিশ্চয়ই প্রভাবিত হয়েছেন, হয়ত রয়েছে চ্যাপলিনের খামখেয়ালিপনার প্রভাবও। ‘হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’-তে কোনান ডয়েলের প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের ছায়াও রয়েছে। কিন্তু সুকুমারের লেখায় মনে হয় তার সৃষ্ট উদ্ভট চরিত্র ও ছবিগুলি অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ, সুপ্রযুক্ত ও ঘরোয়া। বিদেশী লেখক ও তাদের রচনার দ্বারা উৎসাহিত বা প্রভাবিত হলেও সুকুমারের লেখা ছিল স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। তার লেখায় ব্যঙ্গ বা হাস্যরস অফুরন্ত ভাবে উপস্থিত থাকলেও কোন শ্লেষাত্মক ভাব ছিল না। পাঠকদের তিনি আগেই তার রচনার ধরণ ও বৈশিষ্ট্য খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছেন তার ‘আবোল তাবোল’-এর ভূমিকায় –“ইহা খেয়াল রসের বই, সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।”

সুকুমার তার লেখার অন্য কোন উদ্দেশ্য বা গূঢ়ার্থ সম্বন্ধে কোথাও মন্তব্য করেছেন কিনা জানা নেই; কিন্তু কিছু বিদগ্ধ পাঠক তার রচনায় সমসাময়িক সামাজিক প্রেক্ষাপটে কিছু রাজনৈতিক ঘটনার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন। হতে পারে, প্রতিভাধর ব্যক্তিদের চিন্তা ও মননে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী অবচেতন ভাবে তাদের রচনায় প্রতিফলিত হয়। সুকুমারের রচনা ‘বাবুরাম সাপুড়ে’-তে বর্ণিত চোখ-শিং-নখ বিহীন সাপ হ’ল আমাদের সমস্ত জীবনের প্রতীক, এটাই অনেকের ধারণা। আমরা চাই আমাদের জীবনের সমস্ত সমস্যা যেন ঐ নিস্তেজ সাপের মত হয়, যাতে মুখোমুখি হয়ে সংগ্রাম না করে বাধাহীন ভাবে অনায়াসেই আমরা প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে পারি। অনেকে তার কবিতার নিহিতার্থ ব্যাখ্যায় ব্রিটিশ সরকার, গান্ধীজী এবং নানা আন্দোলনকেও এনে উপস্থিত করেছেন। এ নিয়ে বেশি কথা বলে কাজ নেই। 

সুকুমার আমাদের কাছে সরস ও সজীবতার মূর্ত প্রতীক হয়েই থাকুন। জীবনের শেষ আড়াই বছর রোগ শয্যায় শুয়ে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত জেনেও অচঞ্চল ও অবিচলিত চিত্তে যেভাবে তিনি একনিষ্ঠ ভাবে পত্রিকার কাজ করে গেছেন, তার এই কর্মযোগের আদর্শ যেন আমাদের চিরদিন অনুপ্রাণিত করে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত