সঙ্গীত-রাজপুত্র শচীন দেব বর্মন

প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০১৭, ১১:০৩

সবাই যাকে এস ডি বর্মণ নামে জানে সেই সঙ্গীত-রাজপুত্র শচীন দেব বর্মনের জন্ম ১৯০৬ সালের পহেলা অক্টোবর কুমিল্লায় (ত্রিপুরা) চন্দ্রবংশে মানিক্য রাজ পরিবারে। তাঁর গায়কীর অনুনাসিক ঢং ও মিষ্টি কণ্ঠস্বরের জন্য শ্রোতাদের কাছে আলাদা করে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। শুধু গান গাওয়া নয়, সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে তার নামের সাথে সবাই পরিচিত। শৈশবচিত্র তুলে ধরলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিনি জন্মসূত্রে এবং মনে-প্রাণে বাঙালি ও বাংলাদেশী। 

বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেব বর্মণ, মা মণিপুরি রাজবংশের মেয়ে নিরূপমা দেবী। রাজপরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ ও অন্যতম। ত্রিপুরা সম্বন্ধে এমনিতেই প্রবাদ ছিল, সেখানকার রাজবাড়িতে রাজা-রানি, কুমার-কুমারী থেকে দাস-দাসী পর্যন্ত সবাই গান জানে, গান গায়। সেই পরিবেশে বড় হওয়া রাজকুমার শচীন কর্তা যে সুরের রসে মজে থাকবেন এবং মজাবেন সেটাই তো স্বাভাবিক।

রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের অর্থানুকূল্যে, কুমিল্লার চর্থায় ৬০ একর জমি নিয়ে প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন কুমার বাহাদুর নবদ্বীপচন্দ্র। এই প্রাসাদেই তাঁর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান শচীন দেববর্মণের জন্ম। ১৯১০ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঠাকুরপাড়ার সুরলোক, কান্দিরপাড়ের সবুজ সংঘ নাট্যদল, দি গ্রেট জার্নাল থিয়েটার পার্টি, ইয়ংম্যান্স ক্লাব ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছিল কুমিল্লার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। ত্রিপুরার মহারাজারা কুমিল্লায় তৈরি করেছেন টাউনহল, নাট্যশালা, লাইব্রেরি এবং নানা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সেখানে নিয়মিত আসতেন চলচ্চিত্র পরিচালক সুশীল মজুমদার, ননী মজুমদার, ব্রজেন ব্যানার্জি, জিতু দত্ত, অরুণ মহলানবিশ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। 

সাহিত্যিক, সুরকার, গীতিকার, কবি ও সঙ্গীতজ্ঞগণ একত্রিত হতেন ইয়ংমেন্স ক্লাবে। আড্ডা থেকে ভেসে আসত নজরুল ও শচীন দেবের গান। কাজী নজরুল কুমিল্লা এলে থাকতেন তালপুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটি ঘরে। শচীন দেব বর্মণ কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ওই কলেজ থেকে আইএ পাস করেন এবং পরবর্তীতে একই কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন।

১৯২৩ সালে কলকাতা বেতারে শচীন দেব প্রথম গান করেন এবং ১৯৩২ সালে তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয়। তিনি নজরুল সঙ্গীতও রেকর্ড করেন। এরপর তাঁর বহুসংখ্যক বাংলা ও হিন্দি গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। রেকর্ডকৃত তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গান হলো: ‘যদি দখিনা পবন’ (রাগপ্রধান), ‘প্রেমের সমাধি তীরে’ (কাব্যগীতি), ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে’ (পল্লিগীতি), ‘বধুঁগো এই মধুমাস’ (পল্লিগীতি), ‘ওরে সুজন নাইয়া’ (পল্লিগীতি) প্রভৃতি। শচীন দেব অনেক বাংলা গানে সুর দিয়েছেন।

শচীন দেবের পিতা নবদ্বীপ চন্দ্র দেব বর্মণ ছিলেন একজন সেতার বাদক ও ধ্রুপদ সংগীতশিল্পী। তিনিই ছিলেন শচীন দেবের প্রথম শিক্ষাগুরু। এর পর তাঁর সংগীতশিক্ষা চলে উস্তাদ বাদল খাঁ ও ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে। ধ্রুপদ সংগীতশিক্ষা গ্রহণের ফলে তাঁর মধ্যে সংগীতের মৌলিক জ্ঞান সঞ্চার হয়। শচীনকর্তার পরবর্তী জীবনে সুর সাধনায় প্রভাব বিস্তার করেছিল এই শিক্ষা। এরপর তিনি উস্তাদ আফতাব উদ্দিন খাঁ সাহেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। 

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে পিতা নবদ্বীপচন্দ্র কলকাতায় দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী। শচীন দেব তখন থাকতেন কলকাতার ত্রিপুরা প্যালেসে। 'সারগামের নিখাদ' নামক আত্মজীবনী গ্রন্থে শচীন দেব বর্মণ লিখেছেনঃ "পিতার মৃত্যুর পর আমি যেন অগাধ জলে পড়ে গেলাম। এই অবস্থায় আমি আগরতলা বা কুমিল্লা গিয়ে থাকলে রাজকীয় আরামে ও নিশ্চিন্তে নিজেদের বাড়িতে বাস করতে পারতাম এবং রাজ্য সরকারের কোনো উচ্চপদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম। আমার বড় ভাইরা আমাকে তাই করতে বললেন। আমার কিন্তু এ ব্যবস্থা মনঃপূত হলো না। নিজে একলা সংগ্রাম করে, নিজে উপার্জন করে সঙ্গীত সাধনায় জীবন কাটিয়ে দেব। মনের মধ্যে একমাত্র এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কলকাতার ত্রিপুরা প্রাসাদ ছেড়ে ভাড়া করা সামান্য একখানা ঘরে আমার আস্তানা বাঁধলাম।"

১৯৩৪ সালে নিখিল ভারত সঙ্গীত সম্মিলনে গান গেয়ে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৩৭ সাল থেকে পরপর কয়েকটি বাংলা ছায়াছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছায়াছবি হলো: রাজগী, ছদ্মবেশী, জীবন-সঙ্গিনী, মাটির ঘর ইত্যাদি।
শচীন দেব বর্মন ১৯৪৪ সাল থেকে মুম্বাই-এ বসবাস করা শুরু করেন। তিনি প্রায় আশিটির মতো হিন্দি চলচ্চিত্রে অত্যন্ত দক্ষতা ও সৃজনশীলতার সঙ্গে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে তিনি বিশেষ খ্যাতির অধিকারী হন। সেখানে তিনি শিকারী, দেবদাস, সুজাতা, বন্দিনী, গাইড, আরাধনা, বাজি, শবনম, দো ভাই প্রভৃতি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন।

শচীন দেব বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে উচ্চ পদ অলঙ্কৃত করেন এবং বহু সংগঠন কর্তৃক সম্মানিত হন। ১৯৫৮ সালে সঙ্গীত-নাটক আকাদেমি ও এশিয়ান ফিল্ম সোসাইটি (লন্ডন) এবং ১৯৬৩ সালে ত্রিপুরা ললিতকলা কেন্দ্র তাঁকে অভিনন্দিত করে। ১৯৬৯ সালে তিনি ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ উপাধি এবং চলচ্চিত্রে হিন্দি গানের নেপথ্য গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন। অনেক সাংস্কৃতিক দলের বিশিষ্ট শিল্পী হিসেবে তিনি ব্রিটেন, রাশিয়া ও ফিনল্যান্ডসহ বহু দেশ ভ্রমণ করেন।

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন মীরা ধরের সাথে (মীরা দেব বর্মণ)। মীরা ধর ছিলেন তাঁর সংগীতজীবনের বিশ্বস্ত সঙ্গী। মীরা দেব বর্মণও সংগীতাঙ্গনের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সার্থক গীতিকার হিসেবে আমরা তাঁকে জানি। তাঁর রচিত গানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো - শোন গো দখিনো হাওয়া, বিরহ বড় ভালো লাগে, সুবল রে বল বল বল চাই, বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা, কে যাসরে ভাটির গাঙ বাইয়া এবং ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে লেখা উল্লেখযোগ্য গান তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল। তাঁদের সুযোগ্য সন্তান রাহুল দেব বর্মণ (আরডি বর্মণ) মুম্বাইতে সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে সমানভাবে শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

লোকসুরের প্রভাব শচীনকর্তার গানের মধ্যে বরাবরই আমরা লক্ষ করে থাকি। ধ্রুপদ সংগীতের পূর্ণাঙ্গ তালিম নেয়ার পর তাকে লোকসুরের সাথে সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি বাংলা গানের এক আলাদা মাত্রা সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি সুরের মধ্যে বাউল, কীর্তন, ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালি গানের সুর লক্ষণীয়। "কে যাসরে ভাটির গাঙ বাইয়া...." -এ গানের মধ্য দিয়ে গ্রাম্য সমাজের একজন নারীর জীবনের আকুতি ফুটে উঠেছে। মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর সংসারকে আপন ঘর হিসেবে গ্রহণ করে সারাটি জীবন কাটিয়ে দেয় এবং দরিদ্র পিতা অর্থের অভাবে মেয়েকে বাড়িতে আনতে চায় না। এই যে কষ্ট, তা তিনি তার গানের সুর ও গায়কিতে বুঝিয়েছেন। পাশাপাশি গানটির মধ্যে ফুটে উঠেছে বাংলার প্রকৃতির কথা, নদীর কথা, মাঝির কথা, এমনকি বাংলার ঐতিহ্যমণ্ডিত উৎসবের কথাও। জোয়ার-ভাটার নদীতে একজন মাঝির নৌকা বেয়ে যাওয়ার সময় যে ক্লান্তি, দুঃখ, কষ্ট তা তাঁর সুরের মাদকতায় পরিলক্ষিত হয়েছে এ গানের মধ্য দিয়ে।

তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি "বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি" - গানটির মাধ্যমে একজন রাখালের বাঁশির সুরে গ্রামের নারীর মনের ব্যাকুলতাকে তিনি তাঁর সুরের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। পল্লীবাংলার মানুষের মনে যে ভালোবাসা বোধ, যা রাখালিয়া বাঁশির সুরে আকুল হয়ে ওঠে এ গানের মধ্যে সেটি প্রমাণিত। রাধাকৃষ্ণের প্রেমের কথা এখানে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এ গানের সুরে কীর্তনের একটা আভাস বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

"শোন গো দখিনো হাওয়া প্রেম করেছি আমি"- এই প্রেমের গানটিতেও তিনি লোকসুরের প্রয়োগ করেছেন অত্যন্ত সুন্দরভাবে। দরাজ কণ্ঠে মনের অভিব্যক্তিকে উপস্থাপন করেছেন শ্রোতাদের সামনে। এতটা খোলা কণ্ঠে সংগীতটাকে উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য হলো একজন প্রেমিক যখন প্রেমিকাকে ভালোবাসে, তার সে ভালোবাসাটা কেমন তা সবাই জানুক বা তার মনে লুকানো যে বাসনা, তা আজ সবার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠুক। ভালোবাসার জন্য যে সুন্দর মন, যে সাহস থাকা প্রয়োজন, তা তিনি সুরের প্রয়োগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। এ গানের মধ্যে বাংলার ঋতুর কথা যেমন রয়েছে, তেমনি সুরের মধ্যেও রয়েছে মাটির গানের মাদকতা।

"ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা পান খাইয়া যাও মাঝি"- লোকসুরের এ গানটি আজ পর্যন্ত সমানভাবে জনপ্রিয়। গানটির সুর শুনলেই শ্রোতার মনে প্রেমানুভূতি জেগে ওঠে। একজন নারীর ভালোবাসাকে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এ গানের মধ্য দিয়ে। এ গানে শিল্পীর সুরের মাধুর্য এবং তাল-ছন্দের প্রয়োগ পরিপূর্ণ ও সার্থকরূপে ফুটে উঠেছে তাঁর গায়কির মাধ্যমে।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হলো। তখন এই অমরশিল্পী গেয়েছেন, "বাজে তাকডুম তাকডুম বাজে ভাঙ্গা ঢোল, ও'মন যা ভুলে যা কি হারালি ভোলরে ব্যথা ভোল"। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় (১৯৭১) গেয়েছেন একই সুরে "তাকডুম তাকডুম বাজাও বাংলাদেশের ঢোল" । মনে-প্রাণে আজীবন একজন খাঁটি বাঙালি ছিলেন তিনি। জন্মভূমির প্রতি প্রচণ্ড টান অনুভব করতেন। বাংলাদেশ থেকে যখনই কেউ যেতেন তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে জড়িয়ে ধরতেন তাঁকে। তাঁর কণ্ঠে অমর পল্লী সুরের গান "বন্ধু রঙ্গিলা-রে" পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের রচিত আরেক অনন্য সৃষ্টি যা এখনও পল্লীগীতি শিল্পীদের কণ্ঠে ধ্বণিত হয়। কি অনির্বচনীয় সুর আর কি অপূর্ব গায়ন শৈলী। ভোলা কি যায় "তুমি নি আমার বন্ধু" - গানটি? ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় সে সময়ে তিনি প্রচুর আধুনিক বাংলা গান গেয়েছেন এবং সুরারোপ করেছেন।

আগেই আমরা জেনেছি, উপমহাদেশীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওপর অভূতপূর্ব দখল ছিল তাঁর। পরের দিকে তাঁর প্রতিটি গানে এমনকি সিনেমার গানেও বাংলার মাটির সুরের সঙ্গে অপূর্ব মেল বন্ধন ঘটিয়েছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মধুর সুরের। ফলে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য মেলোডিয়াস গান। তিনি ছিলেন মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র জগতের শ্রেষ্ঠতম সুরকারদের একজন। ১৯৭৩ সালে নির্মিত হিন্দী 'অভিমান' ছবির "তেরে মেরে মিলান কি ইয়ে রেয়না", "পিয়া বিনা পিয়া বিনা বাসিয়া বাজে না" তাঁর সুরারোপিত জনপ্রিয় গানগুলোর অন্যতম। এই ছবির গানের সুরারোপই তাঁকে এনে দিয়েছিল পদ্মশ্রী খেতাব। ১৯৬৯ সালে নির্মিত কিশোর কুমারের কণ্ঠে গাওয়া আরাধনা ছবির "মেরে স্বপ্ন কি রানী কাব আয়েগি তু" এবং "রূপ তেরা মাস্তানা" অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় গান "তুমি নি আমার বন্ধুরে" হিন্দীতে রূপান্তরিত করে গেয়েছেন "সুন মেরে বন্ধুরে সুন মেরে মিতওয়া, সুন মেরে সাথীরে"। গানটি উপমহাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় গানে পরিণত হয়েছিল।

"আমি তাকডুম তাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল" - গানটিতে বাংলা গানের লোকজ ধারা বেশি ফুটে উঠেছে শচীনকর্তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। এখানে কীর্তনের সুরেরও মিশ্রণ ঘটিয়েছেন খুব সুন্দরভাবে। বাংলা মায়ের কথা তিনি যে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন, তাঁর সুরে মেশা প্রাণের আকুতিতে তা প্রমাণ করিয়ে দেয় বারবার।

সংগীতে ছন্দের প্রয়োগগুলো ধ্রুপদ ভাবধারার হলেও তাঁর গানে সবসময় বাংলা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার দেখা যায় । বাংলা ঢোল, মৃদঙ্গ, বাঁশি, কাঁসা, মন্দিরা, সানাই জাতীয় বাদ্যযন্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে ধ্রুপদ ছন্দকে মিল করে তিনি সংগীতের এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছেন। তালের নাম ধ্রুপদ হলেও ছন্দটা স্বাভাবিক বাঙালি ঘরানার মতো। চলনটাও ঠিক সহজ-সরল বাংলার মেঠো পথের মতো। সাধারণ মানুষকে সহজেই তাঁর গান আকৃষ্ট করে। মানুষের প্রাণের আকুতি সর্বদাই তাঁর গানে পরিলক্ষিত হয়। বাংলাকে ভালোবেসে বাংলার প্রকৃতির সহজ-সরলতাকে তাঁর গানের সুরের উপজীব্য হিসেবে তুলে ধরেছে বারবার। তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল গানের মধ্যে আমরা তার দৃষ্টান্ত পাই। প্রেম-রস তার গানে সর্বদাই বিরাজমান ‘শোন গো দখিনো হাওয়া, বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, বিরহ বড় ভালো লাগে, কি সাপে দংশে আমায়’ গানগুলো যেন ভালোবাসার এক অনবদ্য সৃষ্টি।

দেব আনন্দ আর শচীন কর্তার জুটি প্রথম থেকেই সুপারহিট। দেব আনন্দ পরিচালনায় আসার পর ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ বানাবেন বলে ঠিক করলেন। সুর দেবার জন্য ডাক পড়ল শচীন কর্তা আর পঞ্চমের। চিত্রনাট্য শোনার পর দু’জনে দু’জনের মতো করে সুর শোনালেন। পঞ্চমের গান বেশি পছন্দ হলো দেবের। তিনি শচীন কর্তাকে খুব নরম গলায় জানালেন, "এই ছবিতে পঞ্চমের সুর বেশি ভালো মানাবে"। "তাহলে পঞ্চম সুর দিক" - হাসিমুখে সম্মতি দিলেন শচীন দেব। ছেলের উন্নতি দেখলে কোন বাবা না খুশি হয়? আগ্রহ নিয়ে একদিন রেকর্ডিং রুমে ছেলের সুর-ও শুনতে এলেন। পঞ্চম সেদিন ‘দম মারো দম’ গান তোলাচ্ছিলেন আশা ভোঁসলের কণ্ঠে। দু’লাইন শোনার পরেই রাগে মুখ লাল এস ডি বর্মনের। চেঁচিয়ে উঠে পঞ্চমকে বললেন, "আমি এই গান তরে শিখাইছি? মাঠের গান ভুলে, বাংলার গান ভুলে, তুই ইংরিজি গানের নকল কইরা সুর করস! আমার সব শিক্ষা বৃথা গেল। তুই আমার কুলাঙ্গার ছেলে" রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে কর্তা যখন মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলেন, সবার দেখে মনে হলো, রাজা যুদ্ধে হেরে বেরিয়ে যাচ্ছেন। রেকর্ডিং রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসে ক’দিন গুম হয়ে বাড়ি বসে রইলেন তারপর শুরু করলেন ‘মিলি’ ছবির গান। সুর দিতে দিতেই paralytic attak হলো কর্তার। কোমায় আচ্ছন্ন বাবার মাথার কাছে বসে ‘মিলি’র গানে সুর দিচ্ছেন পঞ্চম। এই সময় কলকাতায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা চলছে। শচীন কর্তা আজন্ম ইস্টবেঙ্গল-এর সাপোর্টার। দল হারলে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতেন। কর্তার অসুস্থতার সময় ইস্টবেঙ্গল ৫-০ গোলে হারালো মোহনবাগানকে। পঞ্চম সেই খবর চেচিয়ে কর্তার সামনে বলতেই কোমায় আচ্ছন্ন এস ডি চোখ খুলেছিলেন একবারের জন্য! তারপর সেই যে চোখ বন্ধ করলেন, আর খোলেননি চলে যাওয়ার দিনটি পর্যন্ত।

সালটি ছিল ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ। শচীন দেব বর্মন প্যারালিটিক স্ট্রোক হয়ে কোমায় ছিলেন পাঁচ মাস। অবশেষে ৩১ অক্টোবর এ কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা ও শিল্পীর জীবনাবসান ঘটে।

বিশ্বায়নের এ যুগেও আমরা তাঁর গানে মুগ্ধ হই। মাটির টান অনুভব করি, মানুষের প্রতি সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ উপলব্ধি করি। সুরের মাদকতায় মানুষের উপলব্ধি বোধ সৃষ্টি করতে সক্ষম তা তাঁর গানের মধ্য দিয়ে বহুভাবে প্রমাণিত। দেশের প্রতি ব্যাকুলতা বোধ তাঁর গানের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা দিয়ে যায় বারবার। লোকসুর আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের অবস্থানকে, জাগ্রত করে আমাদের অস্তিত্ববোধকে। বাংলা সংগীতের আকাশে এক অনুপম নক্ষত্র শচীন দেব বর্মণ; যাঁর নাম সবসময়ই বাংলা গানের শিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালকদের মাঝে উঠে আসে বারবার। 

বাঙালির নিজস্ব গান লোকসংগীতই বাংলাকে বিশ্বদরবারে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেয়। সেই সবুজঘেরা নদীমাতৃক বাংলার মানুষ, জন্মসূত্রেই যিনি বাংলাদেশী, যাঁর গানের মধ্যে লোকসুরের ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ও বাউল গানের প্রভাব সবসময়ই বিরাজমান, তিনি শচীন দেব বর্মণ। রাগসংগীতের প্রতি অনুরাগ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন রাগসংগীতের ওপর। কিন্তু প্রকৃতি অনুরাগী হয়ে মাটি ও মানুষের প্রাণের সুর সবসময়ই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর গানে। লোকসুরের সহজ-সরলতা আবেগপ্রবণ করে তুলেছে বারবার তার গানে। তার গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে দেশের প্রতি আনুগত্য। আজো কোটি মানুষের প্রাণের মধ্যে বেজে ওঠে তাঁর কণ্ঠের সেই সুমধুর সুর। অমর সুরস্রষ্টা এই মনিষীর প্রয়ান দিবসে আজ তাঁর পুণ্য স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত