কথাসাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী

প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:৫৩

একদিন দিনের বেলা ধূপকাঠি ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে এক চোর ঢুকে পড়েছিল শিবরামের ঘরে। শিবরামের ঘর মানে, কোলকাতা শহরের ২৩৪ মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের সেই বিখ্যাত কক্ষ। মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের সেই মেসের ঘরেই দীর্ঘ ৪০ বছর বসবাস করেছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী।

কোনো কারণে বাইরে গেলে কখনই ঘরে তালা দিতেন না শিবরাম। তালা দেবেনই বা কেন! তাঁর ঘরে মূল্যবান কিছুই তো থাকতো না। চারপাশের দেয়ালে অজস্র নাম-ঠিকানা আর ফোন নম্বর লেখা ছিল। দেয়ালে লেখা ঠিকুজিসমূহ দেখে কেউ প্রশ্ন করলে শিবরাম সোজা বলতেন, "খাতা হারিয়ে গেলেও দেওয়াল হারানোর কোনও সুযোগ নেই।' তা সেই বিখ্যাত মেস ঘরটিতে চোর ব্যাটা ঢুকে গোটা ঘরটি তন্ন তন্ন করে খুঁজে হতাশই হল। চুরি করার মতো কোনো কিছুই পেল না। মনখারাপ নিয়েই ফিরে গেল চোর। সন্ধেবেলা শিবরাম ঘরে ঢুকে দেখেন জামাকাপড়, লেখার কাগজপত্র, কম্বল-বালিশ সব তছনছ। আর তক্তপোশের ওপর রাখা একটি দশটাকার নোট এবং এক প্যাকেট ধূপকাঠি আর একটি চিঠি। চিঠিতে লেখা, "ভাই তোমার ঘরে চুরি করতে এসে দেখলাম তোমার অবস্থা আমার থেকেও খারাপ। কাজকম্মো বোধহয় কিছুই করো না। এই দশটা টাকা রেখে গেলাম। এই টাকায় এই কোম্পানির ধূপকাঠি কিনে ফেরি কোরো। এইভাবে কত দিন চলবে? আমার পরামর্শ মানলে জীবনে উন্নতি করবে।"

শিবরাম চক্রবর্তীর মতো রম্য গল্পকার বাংলাসাহিত্যে বিরল। শিবরাম মানেই হাসির ফোয়ারা। এই মহান গুণী সাহিত্যিক ১৯০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মালদহের চাঁচোলের রাজ পরিবারের সন্তান, যদিও ৭৭ বছর বয়সের মধ্যে বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে তাঁর ভাগ্যান্বেষণে। এক সময় তিনি জীবিকার তাগিদে সংবাদপত্রের হকারিও করেছেন। সেই সময় কলকাতার বিখ্যাত সংবাদপত্র বসুমতী বিক্রি করেছেন। এরপর সওদাগরি অফিসে কম মাইনের চাকরি করেছেন। কিন্তু তখনও লেখা-লেখিতে হাত দেননি। অবশেষে একটা সময় এসে তাঁকে লিখতে হয়। কারণ লিখেই তাঁকে খেতে হয়। দৈনিক বসুমতীর সম্পাদক হেমন্তপ্রসাদ ঘোষই তাঁকে লেখালেখিতে নিয়ে আসেন। সাহিত্যসাধনা শুরু করে তিনি বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন তোলেন। রস রচনা এবং কৌতুক রচনায় সিদ্ধহস্ত শিবরাম গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতাও লিখেছেন। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে 'প্রেমের পথ ঘোরাল আজ এবং আগামীকাল', ‘মেয়েদের মন’, ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা’ প্রভৃতি।

বিচিত্র জীবন ছিল তার। রাজনীতি করেছেন, জেল খেটেছেন, রাস্তায় কাগজ ফেরি করেছেন, ফুটপাথে রাত্রিবাস করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, আজীবন মেস-জীবন যাপন করেছেন। খুব সচেতনভাবেই যেটা করেন নি, তা হল বিয়ে। তাঁর প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অারেক মনস্বী সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, "তিনি ছিলেন অতি অভিজ্ঞ, অতি সুদক্ষ এক সারথি। নিজের রথ কী ভাবে কোন কায়দায় চালাতে হবে তা তিনি জানতেন। এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর কোনও উচ্চ অ্যাম্বিশন ছিল না বলে। জীবনদর্শন ছিল এই রকম -কয়েক দিনের জন্য এসেছি, আনন্দ করতে করতে চলে যাব। এই আনন্দটাও ছিল রিবাউন্স করা। তোমাদের আনন্দ আমার আনন্দ। তোমাদের সঙ্গে খানিক মজা করব। জীবন নিংড়ে এমন কোনও লেখা বের করতে চাই না যার মধ্যে কোনও ইজম আছে।" অথচ একসময়, জীবনের প্রথম দিকে তিনি রাজনীতি ঘেঁষা অবশ্যই ছিলেন। 'ঈশ্বর-পৃথিবীর ভালবাসা'-র শুরুটাই করেছেন এইভাবে "প্রায় লেখককেই নিজের কবর খুঁড়তে হয় নিজের কলম দিয়ে। গায়কের মতো লেখকেরও ঠিক সময়ে থামতে জানা চাই। সমে এসে যথাসময়ে না থামলেই বিষম, সবটাই বিষময় হয়ে দাঁড়ায়। এমনকী কালজয়ী লেখকও যদি যথাকালে না থামেন তো জীবদ্দশাতে জীবন্মৃতের অন্তর্দশা তাঁর বিধিলিপি। অবশ্য মহাকাল কারও কারও প্রতি একটু সদয়। সময় থাকতে থাকতেই তাঁদের নিরস্ত করেন, নিজের পুনরাবৃত্তির পথে আত্মহননের ভোগান্তি তাঁদের আর পোহাতে হয় না। যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র। বিস্ময় থাকতে থাকতেই, রাখতে রাখতেই তাঁরা অস্ত গেছেন।"

শিবরাম সাহিত্যের আকর্ষণের উৎস খুঁজে দেখার প্রসঙ্গ এলে তা এক বাক্যে বলা কিছুটা কঠিন। ভাল রাঁধুনি যেমন বলতে পারবেন না, ঠিক কীসের সঙ্গে কীসের সংযোগে এমন সুস্বাদু একটি খাদ্য তৈরি হল। শিবরামের লেখার মধ্যে একজন মানুষকে দেখতে পাওয়া যেত। না সাধু, না গৃহী সম্পূর্ণ মুক্তমনের একজন। শিবরামের গল্প ও রম্য রচনার অণুতে পরমাণুতে ছড়িয়ে আছে কেবলই হাসি আর হাসি। শিবরাম নিয়মিত লিখতেন না। শিবরাম তখনই লিখতেন যখন তাঁর পকেট থাকতো শূন্য। বিকালে হয়ত প্যাড়া সন্দেশ, একটা ঝালমুড়ি, ডালপুরি অথবা আলুর দম দিয়ে কচুরি খেতে ইচ্ছে হল। কিন্তু পকেটে টাকা নেই। ব্যস্, অমনি বসে গেলেন লিখতে এবং লেখা শেষ করে সম্পাদকের টেবিলে হাজির হলেন। লেখাটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ছাড়ো তো দু'টি টাকা। সম্পাদক সাহেব লেখা নিয়ে হাসতে হাসতে দু'টি টাকা বের করে দিলেন। শিবরাম ঝড়ের বেগে বের হয়ে এসে তাঁর পছন্দের খাদ্য কিনে ডেরায় ফিরলেন। বেশ জমিয়ে খাবেন বলে আগে থেকেই স্থির করেছে, শেষে দেখা গেল আগন্তুক আরো দু'জন অতিথি। কি আর করা, তিনজন মিলেই ভাগ করে খেলেন। পেট না ভরুক, ক্ষতি নেই, মনতো ভরলো।

নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে তার জুড়ি ছিল না। একবার বন্ধুরা শিবরামের মেসবাড়িতে এলো। সকলে জুতা খুলে তার কক্ষে ঢুকছেন দেখে শিবরাম হাসতে হাসতে বললেন, "বুঝেছি, বুঝেছি, আমার ঘরের ময়লা তোমাদের দামী জুতায় লাগবে বলেই তোমরা জুতাগুলো বাইরে রেখে সে ময়লার হাত থেকে কৌশলে জুতাকে বাঁচালে!" শিবরামের ডেরায় একজন থাকবেন এমন সংবাদে চিররসিক শিবরাম বললেন, "শিবের বাড়িতে আপনি থাকবেন, এতো বড়ই আনন্দের কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘদিনের বিছানা-বালিশ আর অনেকদিন ধরে মানে বলতে পারেন বিছানাটা পাতার পর তা আর তুলে দেখা হয়নি। এর নিচের অনেক সরীসৃপই আমার সাথে বসবাস করে। অবশ্য এদের প্রজাতি সাপ, ছুঁচো থাকাটাও বিচিত্র নয়"!

বাউণ্ডুলেপনা ছিল শিবরামের ধমনীতে। তিনি রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী হয়েও সব ছেড়েছুড়ে যেমন ভবঘুরে জীবন কাটিয়েছেন, তেমনটি ক'জনই বা পারে? উত্তরবঙ্গের চাঁচোলের রাজা ছিলেন ঈশ্বরগুপ্ত, রাজার দুই স্ত্রী সিদ্ধেশ্বরী আর ভূতেশ্বরী। রাজা দুই স্ত্রীকেই অপুত্রক রেখে দেহ রাখলেন। তখন সিদ্ধেশ্বরী নিজের বোন বিন্ধ্যেশ্বরীর ছেলে শিবপ্রসাদকে নিয়ে এলেন গ্রাম থেকে। রাজা দত্তক নিলেন শিবপ্রসাদকে। এই শিবপ্রসাদ চক্রবর্তীই হলেন শিবরামের বাবা। শিবপ্রসাদ রাজসম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলেন ঠিকই, কিন্তু রাজত্বে কখনোই মন নেই তার, সংসারে থেকেও তিনি সন্ন্যাসী। জাগতিক কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই শিবপ্রসাদের। শিবপ্রসাদের স্ত্রীও সারাক্ষণ আধ্যাত্মিক জগতেই বিরাজ করেন। শিবরাম ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন বাড়িতে তাঁর বাবা- মা দু’জনের কেউই যেন লৌকিক জগতে থেকেও নেই। ফলে শিবরামেরও কোনোকালে সংসারের প্রতি মায়া জন্মায় নি। একেবারে অল্প বয়সেই কয়েকবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন কিশোর শিবরাম। তাঁর খেয়াল খুশিমতো কখনও পাহাড়, কখনও সমুদ্র দেখতে হারিয়ে গিয়েছেন তিনি। পকেটে একটি পয়সাও নেই, তাতে কি! ট্রেনে চেপে বসে, যেখানে যত দিন খুশি কাটিয়ে আবার তিনি ফিরে আসতেন বাড়ি। বাড়ি এসে দেখতেন এত দিন বাইরে থাকার পরেও বাবা-মা দুজনেই নির্বিকার। আর মায়ের তো বিশ্বাস ছিল মা দুর্গা সবসময় শিবরামকে রক্ষা করেন! এমন পরিবেশে বড় হওয়ার জন্যই হয়তো রাজসম্পত্তি, সংসার কোনও কিছুতেই মায়া জন্মাল না কোনও দিন।

তারপর ওই কিশোর বয়েসেই একদিন পাকাপাকি ভাবে বাড়ি ছেড়ে পালালেন স্বয়ং দেশবন্ধু চিত্তররঞ্জন দাশের সঙ্গে।
দেশের কাজ করতেই হবে। নইলে জীবন বৃথা। চাঁচোলে সভা করতে এলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। গোটা এলাকা ভেঙে পড়ল দেশবন্ধুর ভাষণ শুনতে। কিশোর শিবরামও পোঁছল সেই সভায়। দেশবন্ধুর ভাষণ শুনে এমন উদ্বুদ্ধ হল যে সিআর দাশ যেই ফেরার ট্রেনে উঠলেন অমনই ওই বগিতেই লাফ দিয়ে উঠে পড়ল শিবরাম।
‘‘আপনার সঙ্গে কলকাতায় যাব।’’
‘‘কী করবে গিয়ে?’’
‘‘দেশসেবা। স্বদেশী করব।’’ শিবরামের সাফ জবাব।
‘‘চলো তাহলে।’’
কলকাতায় এসে উঠল এক মেসে, যেখানে সব অল্পবয়েসি স্বদেশীরা থাকে, ইস্কুলে যায়, চরকা কাটে। সব ব্যবস্থা করে দিলেন দেশবন্ধু। তবে এও বললেন, "শুধু দেশসেবা করলে হবে না, সঙ্গে পড়াশোনাও করতে হবে কিন্তু।"

শিবরামকেও স্কুলে ভর্তি করা হল। সেই মেসের কড়া নিয়ম। মেস-ম্যানেজারের হাতে দেশবন্ধু দশটা টাকা দিয়ে বললেন, শিবরামের বই খাতা পেন জামা সব কিনে দিতে। কী করে যেন সেই টাকা শিবরামের হাতে এল!

আর তার পর? দু’দিনের মধ্যেই পুরো টাকা সিনেমা দেখে আর চপ কাটলেট খেয়ে শেষ। ম্যানেজার চড়াও হলেন। কৈফিয়ত চাইলেন, ‘‘কোথায় তোমার বইখাতা? টাকাই বা কোথায় গেল?’’ জেরার মুখে সত্যবাদী শিবরামের তখন সরল স্বীকারোক্তি। ম্যানেজার ধমক দিয়ে বললেন, "তোমাকে আর মেসে থাকতে হবে না। তুমি এখানে থাকলে বাকি ছেলেরাও গোল্লায় যাবে।" ব্যস, আবার শুরু হল ভবঘুরের জীবন!

ছোটদের জন্য তাঁর রয়েছে প্রচুর লেখালেখি। ছোটদেরকে এতটাই ভালবাসতেন যে, সবসময় নিজের ফেলে আসা শৈশবকে ফিরে পেতে শিশুদের মত তিনি থাকতে, খেতে ভালবাসতেন। তার প্রিয় জিনিস ছিল টফি বা চকলেট। লেখালেখি না থাকলে মুখের ভেতরে একটা চকলেট নিয়ে তাকে চুষতে দেখা যেত। শিশু-কিশোরদের সঙ্গে তার এই সম্পর্ক জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে বজায় ছিল। শেষ জীবনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করেছিলেন। কবিতা দিয়ে তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু হয়েছিল, কিন্তু তাঁর প্রতিভার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ কিশোর সাহিত্যে। যদিও তাঁর লেখায় ভিড় করে আছে শ্লেষের অলংকার। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র হর্ষবর্ধন, গোবর্ধন, ইতু ও বিনি পাঠকচিত্ত জয় করেছে। আমৃত্যু অকৃতদার কথাসাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী ১৯৮০ সালের ২৮ অগাস্ট পরলোকগমন করেন। ৬০ বছরেরও বেশি সময় জুড়ে ব্যাপ্ত লেখক জীবনে তিনি ১৫০ টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্য ও সংবাদপত্র জগতে তাই শিবরাম চক্রবর্তী এখনও শিশুদের পরম বন্ধু হয়েই বেঁচে আছেন, আর বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত