কাঁচা মরিচের চড়া মূল্যেও বঙ্গবন্ধু কেন নির্বিকার ছিলেন?

প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৭:০৭

মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার

আমার ঠিক মনে পড়ছে না, ১৯৯১ বা ১৯৯২ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর সরকার দিবসে আমরা আলমডাঙ্গা উপজেলায় একটা আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলাম। ঐ সভার প্রধান অতিথি ছিলেন চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান হক জোয়ার্দার, বর্তমানে উনি চুয়াডাঙ্গা এক আসনের সংসদ সদস্য। জোয়ার্দার সেদিন সভাতে বেশ খানিকটা দেরিতে এসেছিলেন উনার জীপের যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে। সভাতে আসতে উনার দেরী হবে সে খবরটা উনি ফোনে আমাদের জানিয়েছিলেন। আমরা উনার জন্য অপেক্ষা করে দেরীতে অনুষ্ঠান শুরু করে ছিলাম। আনুষ্ঠানিক আলাপ আলোচনা শেষে জোয়ার্দারকে আমি বললাম আপনি তো সামনাসামনি বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলেছেন, আজকে আমাদেরকে বঙ্গবন্ধুর সম্বন্ধে অজানা কিছু বলেন। 

সেদিন উনি অনেক কিছুই আমাদের বলেছিলেন উনার স্মৃতি থেকে, তারমধ্যে একটা ঘটনার কথা আজ স্মরণ করছি। বঙ্গবন্ধু যখন ক্ষমতায় তখন কাঁচা মরিচের সের প্রতি দাম প্রায় একশ টাকা হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় একদিন ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়ির বসার ঘরে বঙ্গবন্ধু সোফায় বসে সবার সাথে কথা বলছিলেন। উনার ঠিক পায়ের কাছে মেঝেতে বসেছিলেন জোয়ার্দার। এমন সময় বঙ্গবন্ধুর বন্ধু-স্থানীয় কেউ একজন ঘরে ঢুকে উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন, এদেশে কি আর থাকা যাবে, এদেশের যে অবস্থা! বঙ্গবন্ধু তাকে হেসে জিজ্ঞাসা করলেন ক্যান দেশের আবার কি হল, দেশে থাকা যাবেনা কেন? উত্তরে তিনি বললেন যে দেশে কাঁচা মরিচের দাম একশ টাকা সেদেশে ক্যামনে থাকা যাবে?

বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন যখন তোমাদের কারখানার তৈরি লুঙ্গি, শাড়ী, গামছা চড়া দামে আমার কৃষককে কিনতে হয় তখন তো কেউ কোন কথা বলে না। মরিচের দাম একশ টাকা হলে যত সমস্যা। তোমার যদি না পোষায় তাহলে বাড়ির ছাদে, ঘরের বারান্দায় টবে মরিচের চাষ করলেই হল! এতে প্রয়োজন মিটবে এবং একশ টাকা সেরের মরিচ কিনতে হবে না। আমার দেশের বেশীর ভাগ মানুষ কৃষিজীবী, যদি কৃষকের হাতে পয়সা না থাকে তাহলে তারা চড়া দামের লুঙ্গি, শাড়ী, গামছা কিনতে পারবে না, আর সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্রয় ক্ষমতা না থাকলে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে না। অতএব মরিচের দাম বাড়লে পক্ষান্তরে শিল্পপতিরাও লাভবান হবে।

বঙ্গবন্ধুর সময়ে দেশের প্রায় আশি ভাগ মানুষ কৃষিজীবী ছিলেন। জাতির পিতা হিসাবে তিনি সঠিক অবস্থানেই ছিলেন, মরিচের মূল্য বৃদ্ধি উনাকে বিচলিত করে নি। কারণ উনি পঁচানব্বই ভাগ শোষিত জনগণের উন্নতির জন্য রাজনীতি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল এই পঁচানব্বই ভাগ শোষিতের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা। 

এখন যারা শহরে, এমনকি থানা পর্যায়ে বসবাস করে তারা যখন শাক-সবজী কেনে তারা কিন্তু সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিছু কিনতে পারে না। কয়েক হাত ঘুরে তারপর ভোক্তার হাতে আসে আর দাম বাড়তে থাকে ক্রমান্বয়ে। চাল ডাল সবকিছুর ক্ষেত্রে একই অবস্থা, যখন কৃষক কিছু বিক্রি করতে আসে তখন দাম কম এমনকি উৎপাদন খরচ জোটে না কৃষকের ভাগ্যে। দু’সপ্তাহ যেতে না যেতে দাম বাড়তে থাকে কিন্তু ততক্ষণে সবকিছু কৃষকের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এটা হলফ করে বলা যায় বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় মধ্যসত্ত্বভোগীর দৌরাত্ব এখনকার মত ছিল না। তখন কৃষক তার পণ্য হাটে-বাজারে নিজে সরাসরি খুচরা ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে পারতো। সেক্ষেত্রে মরিচের দাম বাড়লে দেশের বেশির ভাগ জনগণ তথা কৃষক তার সুফল পাচ্ছিল, সেটা বঙ্গবন্ধু জানতেন বলেই নির্বিকার ছিলেন। 

বঙ্গবন্ধু রাজনীতি শুরু করেছিলেন ক্ষমতায় যাবার জন্য (একথা উনি আত্মজীবনীতে বলেছেন), কারণ ক্ষমতা না থাকলে শোষিত জনগণের জন্য কিছু করা যাবে না। 

একজন নেতা কতটা সৎ হলে, জনগণের কাছে কতটা দায়বদ্ধ হলে সে বলতে পারে, “সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্য সাড়ে সাত কোটি কম্বল, আমারটা গেল কোথায়?” যখন তাঁর জোট ক্ষমতায় তখন বঙ্গবন্ধুর কম্বল চুরি হয়েছে আর একথা উনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন। এটা ঐ চোরদের অবশ্যই পছন্দ হয় নি। সুবিধাবাদী ও চোরদের শোষণ-অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে এমন কিছু বলেছিলেন যে, “ঘুঘু তুমি একবার ধান খেয়ো, বারবার ধান খেয়ো না। বারবার ধান খেলে তোমার পেট চীরে ধান বের করে নেব।” 

সেদিন বুঝি নি কিন্তু আজ বুঝি এ ভাষণের পরই চূড়ান্তভাবে তাঁর মৃত্যু-ঘণ্টা বেজেছিল। চোর এবং ঘুঘুদের টনক নড়ে গিয়েছিল। একথার পর তারা বুঝতে পেরেছিল নেতা কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন। অতএব তারা বসে থাকে নি! বঙ্গবন্ধুকে মারার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। এসব চোর ও ঘুঘুরা আওয়ামী লীগে ছিল, সেনাবাহিনীতে ছিল, আমলাদের মধ্যে ছিল, রক্ষীবাহিনীতে ছিল। ছিল আন্তর্জাতিক পরিসরে। এরাই সেই শোষক পাঁচ ভাগ, এর প্রমাণ আমরা দেখেছি ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টের পর বারবার।

সব থেকে দুঃখের বিষয় হল যে পঁচানব্বই ভাগের জন্য জাতির জনক জীবন দিলেন তারা কি বোঝে তাঁর আত্মত্যাগ, না অবশ্যই না।

লেখক: প্রবাসী বাঙালি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত