ঘুষ প্রাপ্তিস্বীকারপত্র দিয়ে সম্পন্ন হয় না

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০১৬, ১৮:০৪

চট্টগ্রাম নগর সংলাপ’ অনুষ্ঠানে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ৫ শতাংশ কমিশন, পাঁচ শতাংশ কেটে রাখতে চাওয়া, নতুন পাজেরো জিপ-এর দাবি বিষয়টি জনসমক্ষে এনেছেন চসিক মেয়র। এ ধরনের অভিযোগ দুর্নীতির বিস্তারকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেওয়া এবং জনগণের প্রতি দায়িত্বপালনের চাপ এড়াতেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও অনৈতিক এই দাবির কাছে পরাজয় মেনে নিয়ে কম বরাদ্দগ্রহণ ও অভিযোগেই সমাধানের দায়িত্বশীল উদ্যোগ নয়। মেয়র যদি অভিযোগের বিষয়ে নগর সংলাপে বলার আগে দায়িত্বশীল কর্তাদের অভিযোগটি দিয়ে আসতেন এবং নগরবাসীকে নিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতেন তা হলে আরও ভালো ফল পাওয়া যেত। অবশ্য এতে সমস্যাও ছিলো, কেননা চসিকের যে ঘুষ দুর্নীতি আছে সেটির অবস্থা কোথায় দাঁড়াতো, তাছাড়া তিনিতো রাস্তার লোক (!) নন-কেন এমন উদ্যোগ নিবেন? এরপরও যতটুকু হয়েছে তাতেও ধন্যবাদযোগ্য মাননীয় মেয়র আ জ ম নাছির।

স্থানীয় সরকার বিভাগ চসিক মেয়রের অভিযোগ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, সেটিও ধনাত্মক, তবে প্রতিক্রিয়ার যে ভাব-ভঙ্গি তাতে মনে হয়, এমনটা এবারই প্রথম ঘটেছে!কিন্তু বাস্তবতাতো ভিন্ন কথা বলে।এই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একেবারে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ঘুষ-দুর্নীতির যে চিত্র, তা এই দপ্তর সম্পর্কে বিন্দুমাত্র খোঁজ-খবর রাখেন এমন যে কেউ অবলীলায় বলে দিতে পারবেন।

উপজেলা পর্যায পর্যন্ত যত অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ হয় তার বিপরীতে ঠিকাদারের প্রাপ্য পরিশোধের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫% (শতকরা ৫ টাকা)হারে ঘুষ দেওয়াটাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তরের প্রথা। এই প্রথায় নির্ধারিত ভাগের অংশ অর্থাৎ ৩% যায় সাব-এসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (যাকে ঠিকাদাররা এসও স্যার বলে সম্বোধন করেন)-এর অনুকূলে, যার একটি অংশ নির্ধারিত হারে পান ওয়ার্ক এসিসটেন্ট যিনি সার্বক্ষণিক কাজের সাইটে দায়িত্ব পালন করেন এবং আর একটি অংশ পেয়ে থাকে উপজেলা ট্রেজারি অফিস (বিলের পরিমাণ অনুযায়ী ১ হাজার বা তদুর্ধ্ব প্রদান করা হয়)। ৫%-এর বাকি দুই পার্সেন্ট-এর ১% উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার এবং ১% উপজেলা নির্বাহী অফিসার পেয়ে থাকেন অবধারিত ভাবেই।তবে কখনও কখনও কোনো কোনো উপজেলায় এমন নির্বাহী অফিসার পাওয়া যায় যিনি নিজের ভাগের টাকাটি নেন না। কিন্তু এই ১%-এ ঠিকাদারের কোনো লাভ নেই। প্রথা অনুযায়ী পুরোটাই উপজেলা প্রকৌশল দপ্তরের।

ঘুষ-দুর্নীতির গল্পটি এখানেই শেষ না! বর্ণিত হিসাবটি উপজেলা পর্যায়ের নিয়মিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ঘুষ খতিয়ান মাত্র। এর বাইরে এই দপ্তরের আয়বর্ধক অপর একটি খাত হলো, বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প (এডিপি) বাস্তবায়ন। ঠিকাদারদের ভাষায় এই এডিপি-এর আওতাধীন কাজের নাম ‘মার মার কাট কাট’, যার অর্থ এই প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামোখাতে যে সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হয় চাইলেই তার কমপক্ষে ৫০% লাভ করা যায় আবার কাজ না করেই বিল পাওয়া সম্ভব।ফলে এডিপি-এর আওতাধীন প্রকল্পের বিল প্রদান ক্ষেত্রে ঘুষের হিসাবটি ভিন্ন। এ সময় ঘুষ আদান-প্রদানের যে চিত্র তা দেখে অনায়াসে মনে হবে ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর যেন যৌথ বিনিয়োগের পার্টনার। যে সকল কারণে এই পার্টনারশিপ তা হলো-

১) এই প্রকল্পের আওতাদিন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ৩০ জুন-এর মধ্যে শেষ করা ও বিল দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে; ২) প্রকল্প অনেক কিন্তু জনবলকাঠামোর কারণে যথাযথ তদারকীরও সুযোগ থাকে না। যেমন- গুণগতমান যাচাই ও নিশ্চত করা। আবার এমনটিও দেখা যায়, নিয়ম অনুযায়ী ঠিকাদারকে প্রকল্পের সাইট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও ছোট প্রকল্পগুলোতে ঠিকাদার নিজ উদ্যোগেই সাইট সিলেকশনের কাজটি করেন। কেননা নির্দিষ্ট প্রণালীর মধ্যে কাজটি করলে তার কাজটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা যাবে না; ৩) কখনও কখনও এমন অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়া হয়, যেটি বাস্তবায়ন না করলেও কোনো যায় আসে না। অবশ্য এ ধরনের বিলের সুফল ভোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়, যারা রাজনৈতিক-কিংবা প্রশাসনিকভাবে প্রভাবশালী তারা সকলেই এর সুফল পান; ৪) এডিপি মৌসুমের কাজ শুরুর আগেই কাজের বিপরীতে বিল তৈরির কাজ শেষ করতে হয়। এ জন্য ঠিকাদার কাজ শেষ করার আগেই বিল জমা দেন এবং এই অগ্রীম বিলের টাকা হয় ঠিকাদারের পকেটে না হয় উপজেলারি কোনো নির্দিষ্ট একাউন্টে জমা রেখে কাজ শেষে পরিশোধ করা হয়।

বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের এই ব্যবস্থাপনা সম্পাদনেই নির্দিষ্ট কমিশন প্রথার বাইরে গিয়ে ঠিকাদারের লাভের অনুপাত হিসেব কষে কমিশন নির্ধারণ করার প্রবণতা বিদ্যমান।

এ বিষয়টি নিয়ে বলার উদ্দেশ্য, বাংলাদেশে এমন অনেক খাত আছে, যা পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করলে ঘুষ-দুর্নীতির অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। বর্ণিত বিষয়ে কেউ যদি প্রমাণ দিতে বলেন, তাহলে আমার মতো অধম রাস্তার লোকের পক্ষে তা উপস্থাপন অসাধ্য এবং চেষ্টা করাও জীবনহানির কারণ হতে পারে। তাছাড়া ঘুষ-দুর্নীতি বিষয়টি এমন যে, এটি কখনও লিখিতভাবে দাবি কিংবা পরিশোধ যেমন হয় না তেমনি পরিশোধের প্রাপ্তিস্বীকারপত্র দেওয়ার ব্যবস্থাও স্বীকৃত নয়।

ঘুষ গ্রহণের কিছু অভিনব পন্থা অনুসরণের খবরও সর্বজনবিদিত। যেমন- যখন মোবাইল ব্যাংকিং ছিলো না তখন ফেক্সিলোডের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হতো। প্রশ্ন হতে পারে কথা বলে আর কত টাকাই ব্যবহার করা যায়! না, এই টাকা কথা বলে শেষ করতে হতো না। যারা ফ্লেক্সিলোডের দোকান করেন তাদের অনুকূলে টাকা দেওয়া হতো, যা তিনি নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে একটি কমিশনের মাধ্যমে পরিশোধ করতেন। অর্থাৎ কমিশনের কমিশন ভোগ! আমার ধারণা আমাদের দেশে মোবাইল ব্যাংকিং-এর ধারণাটি এভাবেই এসেছে। তাছাড়া তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের টয়লেটের দরজায় চাপা দেওয়া ইটের নিচেও ঘুষের টাকা রেখে পরিশোধ করা হয়েছে কিংবা কর্মকর্তাকে একটি বই ধরিয়ে দিয়ে সেই বইয়ের মাঝে টাকা লুকিয়ে ঘুষ পরিশোধের কথা শোনা গেছে। অবশ্য এভাবে ছোট লেনদেনগুলো সম্পন্ন হয়েছে। বড় লেনদেনের হিসেবে ভিন্ন, কেননা কখনওই রাঘব বোয়ালদের ধরা যায় না।

ঘুষ-দুর্নীতি যে বিস্তৃত পরিসরে চলে তারও প্রমাণ ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি কমিশন গঠিত হয়েছিলো যেখানে সরকারি বড় বড় কর্মকর্তারা তাদের দুর্নীতি দায় স্বীকার করেছিলেন। এটিতো কারো অজানা নয়।

লেখাটি এখানেই শেষ করতে চাই। শুধু এটুকু বলে যে, মেয়র আ জ ম নাছির যেহেতু রাস্তার লোক নন, একজন মেয়র এবং সরকারি দলভুক্ত রাজনীতিকও বটে, তিনি যখন বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে এসেছেন তখন রাষ্ট্র হয়তো নড়ে চুড়ে বসবে। যদিও তার চাইতে বড় কোনো অন্দরমহল বাসীন্দার হস্তক্ষেপে সবকিছু চেপে যাওয়ার সুযোগ থাকছে না-এমনটি ভাববার পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উত্তরণ এখনও ঘটেনি। এখনও বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র হলেও সবকিছুই চলে আমলাতন্ত্রের মর্জিমাফিক, যেখানে রাজনীতিকরা খেলার পুতুল।

তবুও পথচেয়ে বসে আছি, স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জ্যোতির্ময় দত্ত স্বাক্ষরিত চিঠিতে ‘কোন কর্মকর্তা কোথায় কখন ঘুষ দাবি করেছেন, কে কোথায় কখন পাজেরো জিপ চেয়েছেন’ তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে উপযুক্ত প্রমাণ দাখিল করতে মেয়র নাছিরকে জানানো অনুরোধের প্রতিক্রিয়ায় কী পাওয়া যায় তা দেখার জন্য। 

জীবনানন্দ জয়ন্ত ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত