শনির হাওরের ১০ হাজার হেক্টর বোরো জমি ঝুঁকিতে
প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:৫৭
সুনামগঞ্জের অন্যতম বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ শনির হাওরের কৃষকদের বোরো ফসল রক্ষায় ৩ নম্বর পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) প্রায় ১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণে বালু মাটি ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। তিনটি পাহাড়ি নদীর মোহনার মুখে পড়েছে এই বাঁধটি। এখানে বালু মাটির বাঁধ নির্মাণ করায় কৃষকদের দুশ্চিন্তা বেড়েছে। এছাড়াও হাওরপাড়ের ঘরবাড়ির ভিটের মাটি কেটে বাঁধ নির্মাণের অভিযোগও রয়েছে।
শনির হাওর তিনটি উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত। তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশার কৃষকদের জমি রয়েছে এই হাওরে। এই তিন উপজেলার লাখো কৃষক শনির হাওরে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমি আবাদ করছেন। বেশি জমি তাহিরপুর উপজেলার কৃষকদের। এই উপজেলার কৃষকদের সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে হাওরে।
প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলে যাদুকাটা, বৌলাই ও রক্তি নদীর উপর প্রথম চাপ আসে। এই তিন নদী দিয়ে পানি সমতলের দিকে প্রবাহিত হয়। নদী ভরাট ও অপরিকল্পিত বাঁধের কারণে অকাল বন্যা মৌসুমে প্রতি বছরই উদ্বিগ্ন থাকেন এখানকার কৃষকরা।
তাহিরপুরের ৩ নম্বর পিআইসির বাঁধ গত বছর ভাঙেনি। তবে গেল জুনের বন্যায় এই ব্যাপক ক্ষতি হয় বাঁধের। সেই সঙ্গে তিন নদীর মোহনা হওয়ায় বাঁধের উপর কিছু ঘরবাড়িও ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফলে কিছু পরিবারকে ভিটে মাটি ছাড়া হতে হয়েছে। এজন্য বাঁধ টেকসই ও মজবুত করতে এবার বাঁধের স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। নদীর পাড়ের পুরোনো বাঁধ থেকে সরিয়ে নতুন করে কৃষকদের জমির উপর দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে বাঁধের বাইরে থেকে যাচ্ছে কিছু বাড়িঘর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃহত্তর শনির হাওর রক্ষায় প্রথম বাঁধ এটি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের টেকনিক্যাল টিম এসে বাঁধের স্থান পরিবর্তন করেছেন। হাওরের বিশ জন কৃষকের জমির উপর দিয়ে নতুন বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। শুরুতে কৃষকদের এনিয়ে অভিযোগ থাকলেও এখন নেই।
নীতিমালা অনুয়ায়ী ৩ নম্বর পিআইসির এই বাঁধের দৈঘ্য ৯০৪ মিটার। মাটি ফেলতে হবে ৬ হাজার ২০৪ ঘনমিটার। এতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৪ লাখ ৫৫ হাজার ৫০২ টাকা। পাহাড়ি তিন নদীর মোহনায় তাহিরপুরের আনোয়ারপুর বাজার থেকে দক্ষিণকূল গ্রাম পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। এই বাঁধের বেশিরভাগ অংশ কৃষকদের জমির উপর দিয়ে করা হচ্ছে। নদীগুলো দিয়ে পাহাড়ি ঢলে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে বালু ভেসে আসে। সে বালুতে নদীর পাড়ে ঘন আস্তরণ পড়েছে। নদীর পাশ থেকে বালু তুলেই বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। গত বছরের পুরোনো বাঁধ থেকেও মাটি কেটে বাঁধে ফেলা হচ্ছে। কাটা হচ্ছে বন্যায় বাড়িঘর ভেসে যাওয়া স্থায়ী ভিটার মাটিও।
দক্ষিণকূল গ্রামের নদীর পাড়ের বাসিন্দা শেফালি বেগম। গেল জুনের বন্যার প্রবল পানির স্রোতে বাড়ি ঘর বাসিয়ে নিয়ে গেছে। পরে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, যে জায়গা থেকে মাটি কেটে বাঁধ করা হচ্ছে সেখানে আমার ঘর ছিলো। বন্যার সময় ভেঙে গেছে। পরে আর আসিনি এখানে, এখন ভিটার মাটি কেটে বাঁধ করা হচ্ছে। মেম্বার চেয়ারম্যান বলেছে আমাকে সাহায্য করবে। যদি ভিটার মাটি দিয়ে দেই তাহলে বাড়ি ঘর নির্মাণ করে দিবে। সেই আশায় কিছু বলছি না।
একই গ্রামের বাসিন্দা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, নদীর পাড়ের জায়গা ভেঙে গেছে। তাই পুরানো বাঁধ ও বাড়ির ভিটা থেকে মাটি কেটে নতুন বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। একই গ্রামের বাসিন্দা মো. মঞ্জুল আলী বলেন, আগের বাঁধ থেকে অল্প কিছু মাটি আনা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ মাটি নদীর পাড় থেকে আনা হয়েছে।
পাহাড়ি ঢলের কারণে বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে উল্লেখ করে অভিযুক্ত ৩ নম্বর পিআইসির সদস্য সচিব মো. বাবুল মিয়া বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী আমি বাঁধের কাজ করছি। বালু মাটি দিয়ে বাঁধ করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদীর পাড়ে যে মাটি রয়েছে সে মাটি দিয়েই বাঁধ নির্মাণ করছি। এসময় বালু মাটির বাঁধেই কৃষককের ফসল রক্ষা করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তাহিরপুর উপজেলা ফসল রক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. শওকত উজ্জামান বলেন, আগের বছর বাঁধটি অক্ষত থাকায় এখানে পিআইসি গঠন করা হয় নি। তখন নদীর পাড় দিয়ে ছিলো বাঁধ। গেল জুনের বন্যায় বাঁধের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাই বাঁধ স্থায়ী করতে বা সুরক্ষার জন্যই স্থান পরিবর্তন করে কাজ শুরু হয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুপ্রভাত চাকমা বলেন, ওখানে অনেকদিন ধরে একটি বাঁধ ছিলো। তিন নদীর মোহনা হওয়ায় বন্যায় সেটি ভেঙে যায়। পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কা এখানে লাগে। তাই পানি উন্নয়ন বোর্ডের টেকনিক্যাল টিম সার্ভে করে বাঁধের স্থান পরিবর্তন করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, নতুন বাঁধের জায়গায় পনেরো থেকে বিশ জনের জমি পড়ে গেছে। আমরা কৃষি অফিস থেকে তথ্য নিয়ে জেনেছি ওখানে ধান তেমন করা হয় না। প্রথমে একজন কৃষক অভিযোগ করলেও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও মেম্বারের মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন কোনো অভিযোগ নেই।
সাহস২৪.কম/এএম.