জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

এস ওয়াজেদ আলি

প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:৪৭

১.
মননশীল প্রাবন্ধিক, গল্পলেখক ও ভ্রমণকাহিনী রচয়িতা এস ওয়াজেদ আলি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান ভাবুকের নাম এস ওয়াজেদ আলি, প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদী তাত্ত্বিক। আমাদের দর্শন, পর্যালোচনা ও ভাবুকতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁর মত এমন অনেকের কথাই আমরা জানি না, অনেক মনীষীই আজ বিস্মৃতপ্রায়। মহান চিন্তক এস ওয়াজেদ আলি একজন উদার ও প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন, মনে প্রাণে বাঙালি ছিলেন। মননশীল চেতনা, ইতিহাস ও নীতিজ্ঞান এবং সত্য ও সুন্দরের মহিমায় তাঁর সাহিত্যকর্ম সমৃদ্ধ। তাঁর স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর রচনায়-সাহিত্যে এই দুই গুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তিনি ১৮৯০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শণ্ঠীরামপুর মহকুমার বড় তাজপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, প্রখ্যাত সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক শেখ ওয়াজেদ আলি ১৯৫১ সালের ১০ জুন মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মূলত: 'এস ওয়াজেদ আলি' নামেই পরিচিত। তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁকে প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদী তাত্ত্বিক হিসেবে অভিহিত করেছেন আরেক মনস্বী চিন্তক আবদুল হক। তবে তাঁর জাতীয়তাবাদ পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক ছিল না বলেও আবদুল হক-এর মতোন বিদগ্ধজন মন্তব্য করেন । এস ওয়াজেদ আলি নিজের নামের শেষে পদবি ‘আলি’ বানানেই লিখতে, আর ‘বাঙালি’ লিখতেন ‘বাঙালি’ বানানে, তাঁর রচনার ক্ষেত্রে সেটাই রেখেছি তবে অন্যদের রচনা, উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে ভুল হলেও মূল লেখকের বানানরীতিই অক্ষুন্ন রেখেছি।

২.
সত্য ও সুন্দরের সাধনায়, নীতিজ্ঞান, ধর্মবোধ ও প্রেমের শাশ্বত মহিমায় মার্জিত রুচি ও পরিচ্ছন্ন রসবোধে এস ওয়াজেদ আলির সাহিত্যেকর্ম সমৃদ্ধ। প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ সাময়িকীতেও সে সময় প্রকাশিত হয় তার বেশ কিছু রচনা। তিনি ‘গুলিস্তাঁ’ নামের একটি মাসিক সাহিত্যপত্রও সম্পাদনা করেন। এস ওয়াজেদ আলি তার নিরলস সাহিত্য সাধনার ভেতর দিয়ে মুসলিম ঐতিহ্য ও গৌরবকে সাবলীল প্রবন্ধ ও গল্পের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম বাদশাহী গল্প, মাশুকের দরবার, দরবেশের দোয়া, মুসলিম সংস্কৃতির আদর্শ, গ্রানাডার শেষ বীর, ভবিষ্যতের বাঙালী ও জীবনের শিল্প। এস ওয়াজেদ আলি হিন্দু-মুসলিম মিলনপন্থী ছিলেন। পাকিস্তান পূর্ববর্তী যুগে হিন্দুদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মুসলমান হিসেবে তার খ্যাতি ছিল।তিনি সংশয়হীনভাবে বলতে পেরেছিলেন, ‘আমি যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছি, তাতে হিন্দু তার ধর্মের অন্তর্নিহিত সনাতন সত্যের সন্ধান পেয়েছে, মুসলমান তার ধর্মের অন্তর্নিহিত শাশ্বত সত্যের সন্ধান পেয়েছে; আর উভয়েই মর্মে মর্মে বুঝেছে যে, যেখানে সত্য সেখানে দ্বন্দ্ব নাই; যেখানে সুন্দর সেখানে দ্বেষ হিংসা নাই; যেখানে শ্রেয় যেখানে সঙ্কীর্নতা নাই, কার্পণ্য নাই; আলোকের পথে অন্তহীন একাগ্র অভিযানই সকলের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ (এস ওয়াজেদ আলি, ভবিষ্যতের বাঙালী, প্রথম মুদ্রণ জানুয়ারী ১৯৪৩)। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে পরাধীন ভারতবর্ষে বসে তিনি স্বপ্ন দেখতেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং একটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার। তার 'ভবিষ্যতের বাঙালী' গ্রন্থে তিনি এমনই মতের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এস ওয়াজেদ আলী আমাদের কাছে প্রণিধানযোগ্য এ কারণে যে, আমরা বাংলাদেশের মানুষ বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা আর লাখো প্রাণের বিনিময়ে তার স্বপ্নের রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি।

৩.
শেখ ওয়াজেদ আলির (জন্ম : ৪ সেপ্টেম্বর ১৮৯০ – প্রয়াণ : ১০ জুন, ১৯৫১) পিতার নাম শেখ বেলায়েত আলী; তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী ছিলেন এবং শিলং-এ স্থায়িভাবে বসবাস করতেন। ১৮৯৫ সালে বড় তাজপুর গ্রামের পাঠশালায় মেধাবি ওয়াজেদ আলীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পরে তিনি শিলং মোখার হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯০৬ সালে স্বর্ণপদক লাভ করে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি আলীগড় কলেজ থেকে ১৯০৮ সালে আইএ এবং এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১০ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১২ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় বিএ ডিগ্রি ও বার-অ্যাট-ল সম্পন্ন করেন। ১৯১৫ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইনব্যবসার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯২৩ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন এবং ১৯৪৫ সালে ওই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

৪.
এস ওয়াজেদ আলির প্রথম প্রবন্ধ ‘অতীতের বোঝা’ ১৯১৯ সালে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এস ওয়াজেদ আলি ১৯১৯ সালে Bulletin of the Indian Rationalistic Society নামে একটি ইংরেজি জার্নাল এবং ১৯৩২ সালে গুলিস্তাঁ নামে একটি বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। ১৯২৫ সালে তাঁর ছোটোগল্প ’রাজা’ ইসলাম দর্শন এ প্রকাশিত হয়। তিনি পরপর দুবার (১৯২৫ ও ১৯২৬) বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৭ সালে তিনি উক্ত সমিতির সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এবং একই বছর তাঁর ছোটোগল্পগ্রন্থ গুলদস্তা প্রকাশিত হয়। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি কলকাতা এলবার্ট হলে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সংবর্ধনা প্রদান উপলক্ষে গঠিত সংবর্ধনা কমিটির সভাপতি হিসেবে অভিনন্দন পত্র পাঠ করেন। একই বছর তিনি ‘আসাম মুসলিম ছাত্র সমিতি’-র বার্ষিক সম্মেলনেও সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩০ সালের এপ্রিলে তিনি নোয়াখালী মুসলিম ইন্সটিটিউটের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত ‘নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সম্মিলনী’-তে সভাপতি হিসেবে যোগদান করেন।

৫.
লেখক হিসেবে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ও ভ্রমণকাহিনী রচনায় তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে: প্রবন্ধ জীবনের শিল্প (১৯৪১), প্রাচ্য ও প্রতীচ্য (১৯৪৩), ভবিষ্যতের বাঙালী (১৯৪৩), আকবরের রাষ্ট্র সাধনা (১৯৪৯), মুসলিম সংস্কৃতির আদর্শ; গল্প গুলদাস্তা (১৯২৭), মাশুকের দরবার (১৯৩০), বাদশাহী গল্প (১৯৪৪), গল্পের মজলিশ (১৯৪৪); উপন্যাস গ্রানাডার শেষ বীর (১৯৪০); ভ্রমণকাহিনী পশ্চিম ভারত (১৯৪৮), মোটর যোগে রাঁচী সফর (১৯৪৯) প্রভৃতি। 

৬.
অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভিত রচনার ক্ষেত্রে তার বিশেষ অবদান রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকদের অবদানের মূল্যায়নে তিনি তৎপর ছিলেন। ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী। পান্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধের মধ্যেও তিনি সরস কবিত্বময় স্টাইল রক্ষা করেছেন। এমন একজন ব্যক্তিত্বকে আমরা যেন ভুলে না যাই- এই হোক আমার কামনা। প্রাবন্ধিক, গল্প লেখক ও ভ্রমণ কাহিনী রচয়িতা এস ওয়াজেদ আলী বাংলাদেশ সৃষ্টির অনেক আগেই ১০ জুন ১৯৫১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

৭.
প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব বিবেচনা করে এস ওয়াজেদ আলীর মননশীল প্রবন্ধ ‘ভবিষ্যতের বাঙালি’ থেকে পাঠ করা যাক।- "আমি যে ভবিষ্যৎ বঙ্গদেশের কল্পনা করি, তাতে বর্তমানের মজানদীর এবং শুষ্ক খালের খাতে প্রচুর জলপ্রবাহের আশ্রান্ত কলধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তাদের বক্ষের ক্ষীরধারায় সমস্ত দেশে ফুলে-ফলে-শস্যে অপুর্ব শ্রী ধারণ করেছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তাতে বাংলার প্রত্যেক পল্লিতে এবং প্রত্যেক জনপদে তার নিজস্ব নদী অথবা খাল আছে, যাদের সাহায্যে উদ্বৃত্ত বর্ষার জল অবাধে সাগর পথে প্রবাহিত হচ্ছে – বর্তমানের মত সে জল ম্যালেরিয়ার মশার সূতিকাগারের সৃষ্টি করছে না। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তাতে প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়ি গৃহশিল্পের আলিপনার সুন্দর এক একটি নিদর্শন হয়ে বিরাজ করছে, বর্তমানের মতো গৃহ- সুন্দরর্য- পিপাসুর মনে নিত্য সে নতুন যন্ত্রণার কারণ হচ্ছেনা। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তাতে প্রত্যেক গ্রামের নিজস্ব বাগান, নিজস্ব খেলার মাঠ, নিজস্ব পাঠাগার, নিজস্ব ক্লাব বা ইন্সটিটিউট আছে। আর গ্রামবাসীরা সেইসব প্রতিষ্ঠানে পরস্পর সহযোগিতায় নিত্য নতুন আনন্দের সন্ধান পাচ্ছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তাতে প্রশস্ত সুগঠিত রাজপথ দেশের প্রত্যকেটি গ্রামের সঙ্গে প্রত্যেকটি গ্রামকে, প্রত্যেকটি নগরের সঙ্গে প্রত্যেকটি নগরকে সুলগ্ন রেখেছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তাতে বাংলার গৃহপালিত পশুপক্ষীর শ্রী এবং সৌন্দর্য বাংলার গৌরবের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তার মাংশপেশীবহুল, সুঠাম, বলিষ্ঠদেহ, বাঙালি বৈদেশিকের বিস্ময় উৎপাদন করেছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তাতে বাঙালি নারীর স্বাস্থ্য এবং সৌন্দর্য বিশ্ববাসীর প্রশংসার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তার বিদ্যানিকেতনগুলির স্থাপত্য সৌন্দর্য , তাদের উদ্যানের শোভা, তাদের বেষ্টনীর মনোহারিত্ব মানুষের মনকে সৌন্দর্যের অপরূপ জগতের সন্ধান দিচ্ছে। আর সেইসব প্রতিষ্ঠানের আচার্য এবং ছাত্রদের পরস্পরের স্নেহ এবং প্রীতি নাগরিকদের আদর্শ হয়ে উঠেছে ; তাদের সত্য- শ্রেয়- সুন্দরের সাধনা বিশ্বের অনুকরণীয় গৌরবের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছি, তাতে হিন্দু তার ধর্মের অন্তর্নিহিত সনাতন সত্যের সন্ধান পেয়েছে, মুসলমান তার ধর্মের অন্তর্নিহিত শাশ্বত সত্যের সন্ধান পেয়েছে; আর উভয়েই মর্মে মর্মে বুঝেছে যে, যেখানে সত্য সেখানে দ্বন্দ্ব নাই; যেখানে সুন্দর সেখানে দ্বেষ হিংসা নাই; যেখানে শ্রেয় যেখানে সঙ্কীর্নতা নাই, কার্পণ্য নাই; আলোকের পথে অন্তহীন একাগ্র অভিযানই সকলের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, তাতে জ্ঞানসমৃদ্ধ, ভাবসম্পদে গরীয়ান বাঙালি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, দেশ শাসনের ভার, নেতৃত্বের অধিকার উত্তম- বুদ্ধিবিশিষ্ট যোগ্যতমের উপর অতি সহজভাবেই ন্যস্ত করেছে- নির্বাচনের অপ্রিয়তা ও স্বার্থান্ধতা সেখানে মুছে গেছে। আমি যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, তার সাহিত্য থেকে ফাঁকা আড়ম্বর আর ভাবের দৈন্য চিরতরে বিদায় গ্রহণ করেছে। সত্য- শ্রেয়- সুন্দরের নিত্য নতুন অনুভূতিতে সে সাহিত্য নিত্য নতুন পথ রচনা করেছে। সে সাহিত্যের দৃষ্টি সম্ভাবনাহীন অতীতের দিকে নয়, দৃষ্টি তার সম্ভাবনাপুর্ণ ভবিষ্যতের দিকে। সে সাহিত্য কোন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের জন্য নয়; সে সাহিত্য মানুষের জন্য, বিশ্বমানবের জন্য, চিরন্তন মানবতার জন্য। সে সাহিত্য দৃশ্যমান জগতের সাথে অদৃশ্য জগতের, রূপের সঙ্গে অরূপের, দেহের সঙ্গে আত্মার নিত্য নতুন মিলন- সঙ্কেতে ভরপুর। আমি যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, তার নাগরিক হচ্ছে মানবতার আদর্শের অনিন্দসুন্দর এক প্রতীক; বলিষ্ঠদেহ; অটুটস্বাস্থ্য; জ্ঞানসমৃদ্ধ; ভাবে গরীয়ান; ত্যাগে মহীয়ান; প্রেমে ও দাক্ষিণ্যে সকলের আপন জন; সদা মঙ্গল সাধনে রত; উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় বর্তমানকে রূপায়িত করবার জন্য সদাই ব্যস্ত এবং তৎপর। আমার মনে হয়, এই গৌরবময় ভবিষ্যতের স্বপ্নই হল বাঙ্গালির দেখবার মত স্বপ্ন; এই গৌরবময় ভবিষ্যতের চিন্তাই হল বাঙ্গালির মনের উপযুক্ত চিন্তা; আর এই গৌরবময় ভবিষ্যতের জন্য সাধনাই হল বাঙ্গালির শক্তির উপযুক্ত সাধনা।" (প্রথম মুদ্রণ জানুয়ারী ১৯৪৩)।

৮.
বড় সৃষ্টির জন্য, মহান সৃষ্টির জন্য রেনেসাঁসের স্পিরিট ও প্রগতির চেতনা অপরিহার্য। অতীতের রেনেসাঁসের পুনরুজ্জীবন কিংবা পুনরাবৃত্তি নয়, আমরা চাই নতুন কালের নতুন রেনেসাঁসের মধ্যে প্রগতির তাড়না থাক। আর সেই প্রত্যাশা নিয়েই ‘রেনেসাঁসের স্পিরিট’ প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলছেন, ‘রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) কাল থেকে বাংলা ভাষায় লেখকদের মধ্যে ধারণা যে, ইউরোপ উন্নত, বাংলা অনুন্নত। বাংলাকে উন্নতি করতে হলে ইউরোপকে আত্মস্থ করতে হবে। দেশটাতে তখন ছিল ইংরেজ শাসন। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য আয়ত্ত করে, সেখান থেকে প্রেরণা নিয়ে বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য সৃষ্টি ছিল বাংলার লেখকদের আন্তরিক প্রচেষ্ট। তখন ইউরোপের প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রতিই বাঙালি লেখকরা আকৃষ্ট হতেন। বাংলা সমাজে রক্ষণশীল ধারাও ছিল। প্রগতিশীলও রক্ষণশীলদের বিরোধ ছিল। তলিয়ে দেখলে দেখা যায়, রক্ষণশীলরাও প্রগতিরই পক্ষে, তবে এদের বিচার-বিবেচনা বেশি, ঐতিহ্যপ্রীতি বেশি এবং অগ্রগতি মন্থর। রামমোহন, ভবানীচরণ, ঈশ্বরগুপ্ত, প্যারীচাঁদ, অক্ষয়কুমার, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, জগদীশবসু, প্রফুল্লচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্র, বেগম রোকেয়া, লুত্ফর রহমান, এস ওয়াজেদ আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী প্রমুখ লেখকদের সৃষ্টি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, বাংলা ভাষার এ লেখকরা ইংরেজ থেকে কী ভীষণভাবে গ্রহণ করেছেন। তারা গ্রহণ করেছেন জাতীয় ঐতিহ্য ও স্বকীয় সত্তায় থেকে। ত্রয়োদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ইউরোপে বহমান ছিল রেনেসাঁসের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবধারা, তাতে প্রগতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিবেচনা বিশেষ গুরুত্ব পেত। বাংলা ভাষার লেখকরা ইউরোপের সেই চিন্তাধারার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের প্রেরণা পেতেন।’

৯.
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক আরো লিখছেন, ‘কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দী শেষ হতে না হতেই ইউরোপে দেখা দিতে থাকে কাউন্টার রেনেসাঁস। আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদ রেনেসাঁসবিরোধী কাউন্টার রেনেসাঁসের মনোভঙ্গি নিয়ে বিকাশমান। আধুনিকতাবাদ সীমাবদ্ধ ছিল শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির মতবাদরূপে। জীবন-জগত্ সম্পর্কে চরম নৈরাজ্যবাদকে রূপায়িত করা ছিল আধুনিকতাবাদীদের মূল কর্মনীতি। দুই বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে জীবন ও সমাজের রুগ্ণতাকে তারা শিল্প-সাহিত্য চিত্রিত করতে চেয়েছেন। সমর্থক দৃষ্টি নিয়ে তাঁরা তাকাতে পারেননি জীবন-জগতের প্রতি। আধুনিকতাবাদের ধার একটি মূলনীতি কলাকৈবল্যবাদ। কেবল কলা বা রূপগত সৌন্দর্য নির্ভর করে তাঁরা উত্কৃষ্ট সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। বিষয়বস্তু তুচ্ছ হলে কিছু আসে- যায় না। কেবল উত্কৃষ্ট কলাগুণ থাকলেই কোনো রচনা, কোনো শিল্পকর্ম উত্কৃষ্ট বিবেচিত হবে। কার্যত কেবল অলঙ্কার সৃষ্টির দিকেই তাঁদের মনোযোগের কেন্দ্রীভূত থেকেছে, এবং কলাগুণে উত্কৃষ্ট সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টিতে তাঁরা অসাধারণ কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। নৈরাজ্যবাদ ও কলাকৈবল্যবাদ অবলম্বন করে বাংলা ভাষায়ও সাহিত্য স্থান হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ বাংলা ভাষার সবচেয়ে খ্যাতিমান সাহিত্যিক। বাংলা ভাষার আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদের পাশাপাশি রেনেসাঁস ও প্রগতিবাদের অনুশীলনও বহমান থাকে। রবীন্দ্রনাথ ও শরত্চন্দ্র আধুনিকতাবাদকে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। রেনেসাঁসের স্পিরিটই কার্যকর ছিল তাঁদের সৃষ্টির মূলে। বেগম রোকেয়া, মোহাম্মদ লুত্ফর রহমান, এস ওয়াজেদ আলী, নজরুল ইসলাম ও সওগাত গোষ্ঠীর লেখকদের মধ্যে রেনেসাঁসের ও প্রগতির চেতনাই ক্রিয়াশীল ছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্যও রেনেসাঁসের ও প্রগতির ধারায় সক্রিয় ছিলেন।’ 

১০.
আর তাই আমরা দেখি, উনিশ শতকের উপান্তে এসে বাংলার চেতনহীন মুসলমান সমাজের অতিক্ষুদ্র শিক্ষিত অংশটি আত্মসম্বিৎ ফিরে পেয়ে যখন জাগরণের এষণায় সচেষ্ট হয়ে উঠছে, তত দিনে হিন্দু সমাজ শিক্ষা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিত্ত-বৈভবে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। পার্শ্ববর্তী ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটির দুরবস্থা তাদের চিন্তা-চেতনায় বিশেষ কোনো স্থান পায়নি। এমতাবস্থায় জাগরণকামী মুসলিম লেখক-বুদ্ধিজীবীরা উপলব্ধি করেছেন যে, উন্নতি করতে হলে তাদের স্বতন্ত্রভাবে ও স্বতন্ত্র পথেই তা করতে হবে। একে তারা বলেছেন মুসলমানের জাতীয় উন্নতি। এই উন্নতির একটা বড় উপায় মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা। এই সাহিত্য বিষয়ে ও প্রকরণে হবে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সংস্কৃতি-নির্ভর। বাঞ্ছিত এই সাহিত্যকে কেউ বলেছেন ইসলামি বা মুসলিম সাহিত্য, আবার কেউ বলেছেন মুসলমানের জাতীয় সাহিত্য। পুরো ব্রিটিশ শাসনকাল, এমনকি পাকিস্তান আমলে এসেও এই মনোভাব যথেষ্ট জোরালো ছিল। এই মনোভাবের পেছনে যে দুটো বড় কারণ ছিল তার একটি হচ্ছে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা তথা অতিমাত্রায় ধর্মার্ততা, আর অন্যটি হচ্ছে ভয়। ভয় এ-কারণে যে, এ থেকে বিচ্যুত হলে, দেশীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করলে কিংবা দুই সংস্কৃতির সমন্বয় সাধনের প্রয়াস পাওয়া হলে হিন্দু সংস্কৃতি তাদের গ্রাস করে ফেলবে। সেটা হবে আত্মঘাতী। এ মনোভাবের বাইরে যে কেউ ছিলেন না তা নয়, কিন্তু তাদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। অধিকাংশই ছিলেন প্রবল ধর্মবোধ দ্বারা তাড়িত। এদের মধ্য উচ্চশিক্ষিত বড়মাপের মানুষও ছিলেন। যেমন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও এস. ওয়াজেদ আলি। এরা দুজনই নিজেদের বাঙালি পরিচয়ে কুণ্ঠিত তো ছিলেনই না, বরং এ নিয়ে প্রশংসনীয় রচনাও লিখেছিলেন। 

১১.
প্রাবন্ধিক রবিউল হোসেন ‘আবদুল হক : সাহিত্য-সাহিত্যিক দর্শন’ রচনায় এস ওয়াজেদ আলী সম্পর্কে লিখছেন এভাবে, ‘এস ওয়াজেদ আলী (১৮৯০-১৯৫১) প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদী তাত্ত্বিক। তবে তাঁর জাতীয়তাবাদ পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক ছিল না। ‘বাঙালী মুসলমানের সাহিত্য-সাধনার পথ’ (মাসিক মোহাম্মদী, পৌষ ১৩৩৬) শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লেখেন, ‘আমাদের ধর্ম সবচেয়ে বড়, আমাদের ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত কালচারের ভবিষ্যৎ সবচেয়ে উজ্জ্বল - এই হবে আমাদের সাহিত্য-সাধনার মূলমন্ত্র।’ অবশ্য ‘বাঙালী মুসলমান’ (সওগাত, শ্রাবণ ১৩৩৭) শীর্ষক অপর প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশের অতীত ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ করেন। হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি কামনা করেন। ভবিষ্যতের বাঙালী শীর্ষক গ্রন্থে তিনি ভারতবর্ষকে কতগুলো খন্ড রাষ্ট্রে বিভক্ত করেন - যে-খন্ড রাষ্ট্রের কাঠামো হবে মানবসমাজের সংস্কৃতিগত ঐক্য, ভাষাগত ঐক্য, স্বার্থসম্বন্ধীয় ঐক্য এবং আদর্শমূলক ঐক্য এবং ভৌগোলিক ঐক্যের ভিত্তিতে। আবদুল হক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বলেন, এস ওয়াজেদ আলীই প্রথম স্বতন্ত্র বাংলাদেশের কথা বলেন। সে-অর্থে তিনিই প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদী তাত্ত্বিক। রাজনীতি-ভাবনায় এস ওয়াজেদ আলী ধর্মনিরপেক্ষতার পূজারি ছিলেন। তিনি সর্বদা হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি ও ভারতের মঙ্গল কামনা করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল - প্রকৃত হিন্দু, প্রকৃত মুসলিম এবং প্রকৃত খ্রিষ্টানের মধ্যে বিরোধ হয় না। কিন্তু আবদুল হক বিষয়টির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁর ভাষায় - একথা ঠিক নয়। নিজেদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে তীব্রভাবে সচেতন ব্যক্তির পক্ষে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি সম্ভব নয়, ভারতীয় উপমহাদেশে এই হচ্ছে অভিজ্ঞতা। ঐ ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য-চেতনা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত রাখতে পারলে এবং একটা দৈশিক জাতীয়তাবাদী অনুভব যথেষ্ট পরিমাণে প্রবল হলে তবেই অসাম্প্রদায়িক ধর্ম-নিরপেক্ষ রাজনীতি সম্ভব।’ (কালি ও কলম, সেপ্টেম্বর, ২০১৪, গ্রন্থসূত্র: আবদুল হক, ‘একজন বাঙালী জাতীয়তাবাদী’, নিঃসঙ্গ চেতনা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, প্রাগুক্ত, পৃ ৭৭।)

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত