প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

পণ্ডিত রামকানাই দাশ

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:১৩

১.
বাংলাদেশের প্রখ্যাত লোকসঙ্গীতশিল্পী, সংগ্রাহক, সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত রামকানাই দাশ। একুশে পদকপ্রাপ্ত লোকসংগীত শিল্পী ও মাটির গানের গবেষক পণ্ডিত রামকানাই দাশ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাত সোয়া ১১টায়। মহাপ্রয়াণের আগ পর্যন্ত তাঁর সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ থাকতো দেশ-বিদেশের দর্শক-শ্রোতা। দেশের অনেক খ্যাতনামা শিল্পীও তাঁর কাছে তালিম নিয়েছেন। তিনি তৈরি করে গেছেন অসংখ্য যোগ্য শিষ্য। তাদের মধ্যদিয়েই বেঁচে থাকবেন তিনি কাল-কালান্তর। মনে পড়ছে ঢাকাতে বিভিন্ন সময়ে, নানা আয়োজনে অংশ নেওয়া এই শিল্পীর আনন্দ-মধুর সুরধ্বনি সরাসরি শোনার সুযোগ হয়েছিলো আমার। আবার সিলেটে চাকুরিকালীন সময়ে বার দু’য়েক তাঁর কাছে যাবারও সুযোগ পাই। শিল্পীর সরল, সাধারন কিন্তু বৈভবময় শৈল্পিক জীবন যাপন দেখারও সুযোগ পাই আমার সিনিয়র সহকর্মি মীরাদিদি’র কল্যাণে। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি মহান এই সুরসুধাকরকে, সুরসাধককে। তাঁর প্রয়াণের পরে ছায়ানট আয়োজিত ওস্তাদ রামকানাই দাশ স্মরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয় আমার। সেদিন নানাজনের স্মৃতিচারণের উচ্চারিত আবেগী বাণীও মনে পড়ছে আজ লিখতে গিয়ে।

২.
পন্ডিত রামকানাই দাশের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৫ এপ্রিল সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার পুটকা গ্রামে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রামে। বাবা রসিকলাল দাশ ও মা দিব্যময়ী দাশ ছিলেন লোকসংগীতের সাধক। নেশা হিসেবে জীবনের সূচনালগ্নে গানকে গলায় ধারণ করলেও এক সময় তা পেশা হিসেবেই গ্রহণ করেন পণ্ডিত রামকানাই দাশ। লোকগান এবং উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি জীবিতকালেই ছিলেন বহুল আলোচিত।প্রকৃতির সুনিবিড় তত্ত্বাবধানে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সুরসঙ্গীতের উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত হিসেবে। সৃষ্টিশীলতার উৎকর্ষে আলো ছড়িয়েছেন দেশীয় সংস্কৃতির উর্বর ভূমিতে। একটি সঙ্গীত পরিবারে জন্ম নেন, তাঁর বাবা ও মা দু'জনই ছিলেন লোককবি এবং লোকগানের শিল্পী। তাই খুব ছোটবেলা থেকে গান শুনেই বড় হয়েছেন তিনি। তাঁর বয়স যখন তিন বছর তখনই তিনি বহু গান গাইতে পারতেন। পরবর্তীতে দেশে ও বিদেশের অনেক ওস্তাদের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নিয়েছিলেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর শিক্ষাগুরুরা হলেন ওস্তাদ কালীমোহন চক্রবর্তী, রাজবিহারী চক্রবর্তী, উমেশ চন্দ্র রায়, অরুণ ভাদুড়ী ও ছগীর উদ্দিন খান। সিলেটের বাইরে, দেশে-বিদেশেও গুণী শিল্পী হিসেবে সমাদর পেয়েছেন ওস্তাদ রামকানাই দাশ। রাগসঙ্গীতের শিল্পী হলেও লোকগীতির বৈশিষ্ট্য তার কণ্ঠে যেন অন্য আরো একটি মাত্রা যোগ করেছিলো। তাঁর গানের বাণী ও সুরের শিকড়টি আপন মাটিতে প্রোথিত ছিলো বলেই সঙ্গীতের সর্বক্ষেত্রে তাঁর এই স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ। আর তাই সাবলীলভাবে সঙ্গীত জীবনে রাগরাগিণীর চর্চা, লোকগীতির চর্চা আবার একইসঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাধনাও করে গেছেন ওস্তাদ রামকানাই দাশ। 

৩.
প্রয়াত সংগীতগুণী পন্ডিত রামকানাই দাশ স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলো ছায়ানট, ২০১৪ সালের ১৭ অক্টোবর শুক্রবার।ছায়ানট ভবনের রমেশচন্দ্র স্মৃতি মিলনায়তনে বিকেলে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল। এরপর বক্তব্য দেন সংস্কৃতিজন সারওয়ার আলী। বাবার কাছে শেখা একটি গান ‘আমি যে ডাল ধরি’ পরিবেশন করেন শিল্পী রামকানাই দাশের কন্যা কাবেরী দাশ। এর পর অনুষ্ঠানের সভাপতি সন্জীদা খাতুন শিল্পী রামকানাই দাশের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘ব্যতিক্রমী শিল্পী ছিলেন তিনি। ব্যতিক্রমী ছিলেন কারণ, রামকানাই দাশ সারা জীবন শুদ্ধ সংগীত চর্চা করেছেন, সেই সঙ্গে নজরুল ও রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করেছেন। তাঁর রক্তের সঙ্গে মিশে ছিল গান। রামকানাই দাশ অনেক বেশি প্রজ্ঞার অধিকারী ও সংবেদনশীল ছিলেন। শিল্পীর স্মৃতি রক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহায়তা করবে ছায়ানট।’ সন্জীদা আপা আরো অনেক কথা বলেন, তাঁর আবেগী স্মৃতিচারণ স্মরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের অনুভূতিকে স্পর্শ করে। আপা আরো যে সব কথা বলেন, সে সব কথাও এ লেখা পরের দিকে তুলে ধরবো। ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা আপা স্মৃতিচারণ শেষে ছায়ানট শিল্পী কল্যাণ তহবিল থেকে এক লাখ টাকার একটি চেক তুলে দেন শিল্পীর স্ত্রী সুপর্ণা দাশের হাতে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সারওয়ার আলী ও রামকানাই দাশের কন্যা কাবেরী দাশ। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে পণ্ডিত রামকানাই দাশের জীবন ও সাধনা নিয়ে নিরঞ্জন দে নির্মিত ৪৮ মিনিটের তথ্যচিত্র ‘সুরের পথিক’ দেখানো হয়।

৪.
লোকসঙ্গীত সাধক সঙ্গীত গুরু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও লোকসঙ্গীত শিল্পী পণ্ডিত রামকানাই দাশকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘সুরের পথিক’। ছবিটিতে তাঁর দীর্ঘ সুরময় জীবনের নানা দিক ফুটে উঠেছে। বাংলার লোকসঙ্গীতের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার ও তার ঐশ্বর্য্যের দিকটি এই ছবিতে চিহ্নিত হয়েছে, যার সঠিক লালন করেছেন পণ্ডিত রাম কানাই দাশ। এটিতে মূলত কিছু প্রাচীন লোকগানের অংশবিশেষ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে আছে কবি, ঘাটু, উড়ি, গাজী, ত্রিনাথ, বাউল, টপ্পাসহ লোক আঙ্গিকের বিভিন্ন ধারার গান। এছাড়া সঙ্গীতজ্ঞ প্রয়াত ওয়াহিদুল হক, ড. সন্জীদা খাতুন, ড. করুণাময় গোস্বামী, সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দী, চন্দনা মজুমদারসহ দেশের বরেণ্য কয়েক ব্যক্তির বক্তব্য এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কিছু কিছু অংশ এটিতে স্থান পেয়েছে। ছবিটি নির্মাণ করেছেন নিরঞ্জন দে এবং প্রকাশিত হয়েছে লেজার ভিশনের ব্যানারে।

৫.
আজীবন এই সুরের সাধক ১৯৬৭ সাল থেকে সিলেট বেতারে নিয়মিত সংগীত শিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন শুরু করেন । একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে গান গেয়ে সবার মনোবল সমুন্নত রাখার কাজও করেছেন রামকানাই দাশ। ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠীর শীতকালীন সংগীত সম্মেলনে উচ্চাঙ্গসংগীত পরিবেশন করে তিনি প্রথম সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বাংলাদেশ বেতারের সিলেট কেন্দ্রে সরাসরি সংগীত শিক্ষার আসর ‘সা রে গা মা’ দুই বছর পরিচালনা করেন তিনি। পুরাতনী বাংলা গান নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেন পণ্ডিত রামকানাই দাশ। এই গানকে নাগরিক শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় করতে ভূমিকা রাখেন। দেশে ও বিদেশে তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী রয়েছে। তিনি ছিলেন সংগীত পরিষদ সিলেট সংগঠনের অধ্যক্ষ। তিনি গঠন করেন শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতিষ্ঠান ‘গুরু পরম্পরা’। সঙ্গীত নিয়ে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদিও শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের মানুষ, কিন্তু পিতৃ ও মাতৃ সূত্রে লোকগান আমার অন্তরে গেঁথে আছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে এই গান সংগ্রহ করা আমার একান্ত ইচ্ছা। এবং ইতোপূর্বে এ কাজ শুরুও করেছি। সিলেটের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে আঞ্চলিক গানের শিক্ষা দেয়া আমার খুব ইচ্ছা। এছাড়া প্রাচীন লোকগানের একটি স্বরলিপির বই করতে চাই।’ আর এজন্যই তিনি আমৃত্যু নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘বিনে পয়সার পাঠশালা’য় তিনি দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া ও ছিন্নমূল শিশুদের গান শেখাতেন। বিভিন্ন বয়সের অনেক নারী ও পুরুষও তাঁর কাছে সংগীত শিখতে আগ্রহী ছিলেন। সেই গুণী মানুষটি বিনা পয়সায় গান শেখানো শুরু করেন দরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের। কারণ ওস্তাদ রামকানাই দাশ মনে করতেন, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে দেশে অরাজকতা বেড়েছে। দেশীয় সংস্কৃতির বদৌলতে বিদেশি অপসংস্কৃতি তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করছে। এতে করে দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে না। দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা ছেলেমেয়েদের দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা দানে আগ্রহ থাকলেও টাকার অভাবে তা পারছিলেন না। এ কারণেই তিনি হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের বিনা পয়সার গান শেখানোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। সিলেট নগরের করেরপাড়া এলাকায় নিজ বাসাতেই শুরু হয় তাঁর ‘বিনা পয়সায় সংগীত শিক্ষা’ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা। সংগীত পরিষদের তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তির যোগ্যতা হচ্ছে—গান শিখতে ইচ্ছুক দরিদ্র ও ছিন্নমূল পরিবারের সন্তান। প্রতি শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে ক্লাস শুরু হয়। শিশুদের মর্জির ওপর নির্ভর করে তাদের ছুটি দেওয়া হয়। গানের পর্ব শেষে চলে নৈতিক শিক্ষার পাঠদান পর্ব। এ পর্বে শিশুদের সৎ ও সত্যবাদী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ছুটির আগে রয়েছে বাধ্যতামূলক ফলাহার। ওস্তাদ রামকানাই দাশ ছিলেন দায়িত্ববান মানুষও। সিলেট অঞ্চলের বাউল গুরু কামাল পাশার স্মৃতিকে সংরক্ষিত করার জন্য সুনামগঞ্জে ‘কামাল পাশা স্মৃতি সংসদ’ গঠন করা হয়। আর তিনি ছিলেন তার আজীবন উপদেষ্ঠা মণ্ডলির সদস্য। তিনি তার সিলেটের করেরপাড়াস্থ বাসভবনে বসে ‘কামাল পাশা স্মৃতি সংসদ’ গঠনের ব্যাপারে সবাইকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করতেন। প্রথম জীবনে ভাটি অঞ্চলে কবিগানের প্রচার ও প্রসার এবং পরবর্তীতে শাস্ত্রীয় সংগীতের দীক্ষা দিয়ে পণ্ডিত রামকানাই দাশ এদেশের সঙ্গীত জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাউল গুরু কামাল পাশার গান নিয়ে রামকানাই দাশ অনেক গবেষণা করেছেন। তাই তিনি তার সম্পর্কে বলেন, ‘সেইসব শিল্পীরাই সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবান যারা ওস্তাদ কামাল পাশার মতো উচ্চ শিক্ষিত বাউল শিল্পীর গান শুনেছেন। এবং যারা কামালের গান শুনেনি ও চর্চা করেনি তাদের মতো হতভাগা আর সঙ্গীত জগতে নেই।’ তিনি নেত্রকোনার জালাল কবির নামে ‘জালালগীতি’ বইয়ে প্রকাশিত কয়েকটি গানের উল্লেখ করে বলেন, ‘ওই গানগুলি আমি নিজে কামাল সাহেবকে গাইতে দেখেছি’।

৬.
প্রয়াণের আগ পর্যন্ত তাঁর পাঁচটি একক এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম এ্যালবামের নাম বন্ধের বাঁশি বাজে। এটি প্রকাশ হয় কমিটমেন্ট প্রডাক্টের ব্যানারে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন বের করে 'সুরধুনীর কিনারায়' ও 'অসময়ে ধরলাম পাড়ি' নামে দুটি এ্যালবাম, লেজার ভিশন থেকে বের হয় 'পাগলা মাঝি' এবং সুরের মেলা থেকে বের হয় 'রাগাঞ্জলী' নামে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি এ্যালবাম। এছাড়া নবযুগ প্রকাশনী থেকে ২০১১ সালে 'সঙ্গীত ও আমার জীবন' নামে বের হয় একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। ‘সরল সঙ্গীত শিক্ষা’ নামে প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ডের দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। সাধনালব্ধ কীর্তির স্বীকৃতি স্বরূপ পণ্ডিত রামকানাই দাশ দেশে এবং বিদেশে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। পণ্ডিত রামকানাই দাশকে ২০১৩ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। এর আগে বাংলাদেশ জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ থেকে ২০০০ সালে দেশের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত গুণী হিসেবে রবীন্দ্র পদক, সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ‘বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ ২০১২’ দেওয়া হয় তাঁকে। লোকগানের সেরা শিল্পী হিসেবে ২০১১ সালে ‘সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’ পান। সর্বশেষ ২০১৪ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন স্মৃতি পদক, উর্বশী পদক ছাড়াও দেশ-বিদেশ থেকে বেশ কিছু সম্মাননাও পেয়েছেন। দেশে ও দেশের বাইরে পঞ্চাশটিরও বেশি জাতীয়ভিত্তিক সঙ্গীত সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মৃত্যুকালে পণ্ডিত রামকানাই দাশ স্ত্রী অনিন্দিতা চৌধুরী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।

৭.
গুণী শিল্পী রামকানাই দাশ সম্পর্কে ছায়ানটের সভাপতি সনজীদা খাতুন স্মরণ সভায় স্মৃতিচারণ করেছিলেন, বলেছিলেন অনেক কথাই | সে সব কথা লিখেওছিলেন আপা একটি দৈনিকে। আপার মুখ থেকে স্মৃতির চুম্বকাংশ শোনা যাক। ‘জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, সিলেট শাখায় প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে রামকানাই বাবুর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়। সম্মেলনের প্রতিযোগিতার জন্য নির্ধারিত ‘সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি, ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে’ গানটি শেখাচ্ছিলাম। এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক এসে তবলাবাদকের কাছ থেকে ডুগি-তবলা নিয়ে ঠেকা দিতে শুরু করলেন। দারুণ লয়জ্ঞান তাঁর। ধীরস্থির অনুচ্চ শব্দে রবীন্দ্রসংগীতের উপযোগী সংযত বাজনা তাঁর। ইমন কল্যাণ সুরে তেওড়া তালে বাঁধা গানটি সব মিলিয়ে বেলা শেষে চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি করল। ছাত্র-শিক্ষক সবাই নিমগ্ন চিত্তে গাইতে লাগলাম আমরা।পরেও যতবার সিলেটে গান শেখাতে গিয়েছি, রামকানাই বাবু এসে তবলা ধরেছেন। তাঁর বিশদ পরিচয় কিছুই জানা হয়নি তখন। কেন্দ্রীয় প্রতিযোগিতার সময় কিশোর বিভাগের মানসম্মত ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ নাকি রামকানাইয়ের ছাত্র, এ কথা কানে এসেছে। একবার এক কিশোরের কণ্ঠে ‘ধীরে ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া’ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। যেমন সুরের ধ্যান তেমনি লয়ের বোধ এবং ধীরস্থির গায়ন। শোনা গেল এ ছেলে রামকানাই দাশের শিষ্য। দেখা হতেই যুগপৎ ছাত্র আর গুরুর প্রশংসা করলাম। নম্র বিনয়ে সরে গেলেন। সে গান ভুলতে পারলাম না বহুদিন পর্যন্ত। জানতে পারলাম, রাগসংগীত শিখিয়ে কণ্ঠ দুরস্ত করে গান শেখান এই শিক্ষক। গুরুর স্বর ও লয়ের জ্ঞান, রাগসংগীত আর রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে ভালো ধারণা তো আছেই; শিক্ষার্থীর মধ্যে সেসব সঞ্চারিত করে দেওয়ার ক্ষমতাও আছে। এক রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনে রামকানাইয়ের দিদি সুষমা দাশকে লোকসংগীত গাইতে ডেকেছিলেন ওয়াহিদুল হক। কোনোবার লোকসংগীত, কখনো নজরুলগীতি, কখনো দ্বিজেন্দ্র-রজনী-অতুলপ্রসাদের গান গাওয়ানোর রেওয়াজ আছে সম্মেলনে। জানলাম, ওয়াহিদুল রামকানাই ও তাঁর দিদির গুণবত্তার খবর রাখেন ভালো। রামকানাই নাকি ভালো লোকসংগীতও গান। এমনকি নজরুলের গান শেখানোতেও অত্যন্ত পারঙ্গম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডলে রামকানাই দাশকে শুদ্ধ সংগীত পরিবেশন করতে আহ্বান জানিয়েছিল ছায়ানট। রাগসংগীতের সেই ‘শ্রোতার আসরে’ আরও কয়েকজন গান গেয়েছিলেন। রামকানাই অন্যদের মতো অযথা দৈর্ঘ্য না বাড়িয়ে সুসংবদ্ধভাবে গেয়ে উঠলেন। এখানেও সংযম। দিনে দিনে তাঁর নানা গুণপনার পরিচয় পেতে লাগলাম। টাঙ্গাইলের কেন্দ্রীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনে রামকানাই দাশকে সর্বসম্মতিক্রমে গুণী হিসেবে সম্মাননা জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। রামকানাই বাবুর গানের স্কুলে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে একবার সিলেটে গিয়েছিলাম। মহাব্যস্ততার ভেতরেও রামকানাই বাবু একখানি স্বরবিতান এনে আমাকে বললেন, ‘দিদি, এই যে একমাত্রায় চারটি স্বর গাইবার নির্দেশ রয়েছে, এ কীভাবে গাওয়া যায়’? কোন গান নিয়ে প্রশ্ন, সে কথা মনে নেই। আমি গেয়ে দেখালাম। (এখন ভাবি, তাঁর সামনে ঠিক ঠিক গাইতে পেরেছিলাম তো!)। বললাম, ‘আপনার এত কৌতূহল!’ বললেন, ‘দিদি শিখবার সুযোগ হারাতে চাই না। একটা মেথরও যদি কিছু জানে, আমি তাঁর কাছ থেকে জেনে নিতে দ্বিধা করি না। আমি জানতে চাই।’ অবাক লেগেছিল তাঁর এ রকম অনুসন্ধিৎসায়। ছায়ানটের রাগসংগীত উৎসবে ২০০৮ আর ২০১১-তে দুবার গান করেন রামকানাই। তাঁর গান বড় ভালো লাগত। ওয়াহিদুল হকের ধারণা ছিল, দেশের সংস্কৃতির সুস্থতা বিধানের জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো থেকে খাঁটি লোকগান এনে ঢাকার মানুষকে শোনানো দরকার। ওয়াহিদুলের জীবৎকালে সে আয়োজন করা যায়নি। তাঁর মৃত্যুর পর সেই কথা বাস্তবায়নের আবশ্যকতা উপলব্ধি করে লোকসংগীত উৎসবের আয়োজন হলো। ২০০৭ সালের মার্চের প্রথম উৎসবেই রামকানাই দাশ সিলেটের দল নিয়ে এসে যোগ দিলেন। রামকানাই ‘উরির গান’ পরিবেশন করবেন বললেন। এই গানের দল পথ চলতে চলতে গানা গায়, আর একপর্যায়ে তার সঙ্গে হাতের বিশেষ ভঙ্গি করে একধরনের নৃত্যে মেতে ওঠে। নাচটি দেখলে নাকি মনে হয়, দলে দলে প্রজাপতি উড়ছে যেন। অবশ্য ছোট মঞ্চে সেই নৃত্যযাত্রার শোভা খুলল না। যাই হোক, সেদিন রামকানাই বারবার আক্ষেপ করলেন, ওয়াহিদুলকে ‘উরির গান’ (হোরি) শোনানো হলো না। ওয়াহিদুল হকের জন্মদিন উপলক্ষে মার্চ ২০১২-এর ‘দেশ-ঘরের গান’ অনুষ্ঠানে রামকানাই একক গান করেন। রামকানাই বাবুর সঙ্গীত ও আমার জীবন গ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার আগে পড়ে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। তাঁর সংগীতময় জীবনের কথা পড়ে বিস্ময়বিমুগ্ধ হলাম। মায়ের গান, বাবার গান শুনে বড় হওয়া রামকানাইকে তাঁর পিতা এক জ্ঞাতিভ্রাতার অনুরোধে যাত্রাদলের বালক-ভূমিকায় অভিনয় করতে পাঠান। প্রথাগত শিক্ষা না পেলেও, যাত্রাদলের নানা শিক্ষায় তিনি ঋদ্ধ হয়ে ওঠেন। যাত্রাদলের গীতরচনা, সংগীত পরিচালনা, হার্মোনিয়াম-তবলা বাজানো ইত্যাদিতে পটু হয়ে ওঠা রামকানাই গান আর দেখে দেখে শেখা বেহালা বাজানোর শিক্ষাও দিয়েছেন ছাত্রদের। এসব শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা তাঁর মনকে সুশিক্ষিত করে তুলেছিল। যাত্রাদলের ওস্তাদের কাছে রাগসংগীতের পাঠ নিয়েছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়া-আসা করে সেখানকার গুণীদের কাছ থেকেও শিখেছেন। আসরে আসরে ঘুরে সাংগীতিক শিক্ষায় আলোকিত হয়েছেন দিনে দিনে। পল্লি অঞ্চলের বাউলা, মালজোড়া, ঘাটু, উরি গান বিষয়ে দক্ষতা এবং বিপুল জ্ঞান সংগ্রহেও সক্ষম হয়েছিলেন এই গুণী। এই বাস্তব শিক্ষাই জীবনকথা রচনার ভাষাগত যোগ্যতাও এনে দিয়েছিল তাঁকে। সাধনাধন্য রামকানাই দাশকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। অন্তরে তাঁর স্মৃতি চির-অমলিন থাকবে।’

৮.
এক আলাপচারিতায় শিল্পী রামকানাই দাশ বলেছিলেন নিজের অনেক কথা। বলেছিলেন ‘আমার সহজাত প্রবৃত্তি কেবল সুরের মধ্যেই আবর্তিত হয়’ ।সেই মুখোমুখি আলাপচারিতার চুম্বক অংশ পাঠকের সামনে তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। 
প্রশ্ন : সমগ্র বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ পণ্ডিত রামকানাই দাশকে এক নামেই চেনে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এই অসাধারণ পাণ্ডিত্যের প্রকাশ কিভাবে সম্ভব হলো ?
উত্তর : আমি খুব ছোট থাকতেই গান পাগল মানুষ ছিলাম। আমার চিন্তা-চৈতন্যে কিংবা অবচেতনেও গান আমার ভেতর জগতকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আমার সমস্ত সত্তাজুড়ে গানের উর্ব্বর একটি ক্ষেত্র আমি সহজেই উপলদ্ধি করতে পারতাম। একটু সহজ করে বলা যায়- আমার সহজাত প্রবৃত্তি কেবল সুরের মধ্যেই আবর্তিত হতো। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আমার পরিবেশ ও উপযুক্ত পারিপার্শ্বিকতা। অত্যন্ত অজপাড়া গাঁয়ে আমি জন্মেছিলাম। যেখানে প্রতিদিন কোথাও না কোথায় আউল-বাউল, সারি-মুর্শিদী কিংবা কবি-কীর্ত্তন গানের আয়োজন চলতেই থাকত। আর আমি ছিলাম এগুলোর একনিষ্ঠ ভক্ত-শ্রোতা। সুতরাং একাডেমিক লেখাপড়ার সুযোগ তেমন না জুটলেও গান-বাজনার যেখানে যা পেয়েছি তা গোগ্রাসে গ্রহণ করেছি। এ ছাড়া আমাদের পারিবারিক একটি সঙ্গীতের বলয় ছিল। এমনকি আমার বাবাও গান করতেন। আমার মা ছিলেন খেয়ালি গানের একজন অন্তর্মুখী মানুষ। মনের খেয়ালে তিনি গান বাধতেন, সুর করে গাইতেন আর আমি মুগ্ধ হয়ে তা শুনতাম। এভাবেই আমার গানের জগতে বড় হয়ে ওঠা। অনেকটা কবি সুনির্মল বসুর ভাষায় বলা যায়- ‘বিশ্বজুড়ে পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র
নানানভাবে নতুন কিছু শিখছি দিবারাত্র।’
প্রশ্ন : আপনি গান নিয়ে দীর্ঘ একটি জীবন কাটিয়েছেন। নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়ত সহ্য করতে হয়েছে। সুর-সঙ্গীতের বন্ধুর এই পথ পরিক্রমায় সমালোচনার বিড়ম্বনা কিংবা খ্যাতির আত্মতৃপ্তি সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর : ছোটবেলা থেকেই আমি প্রচণ্ড রকম অনুসন্ধিৎসু মানুষ ছিলাম। কিন্তু কখনও আত্মতৃপ্তির বাসনা আমাকে গ্রাস করতে পারেনি। তাই আত্মতৃপ্ততা আমার অভিধানে নেই; ভাল লাগা আছে। আর সেই ভাল লাগাটুকু আমার অতৃপ্তির বাসনাকে আরও বেশি উস্কে দিয়েছিল। যে কারণে আত্মতৃপ্তির মতো সর্বনাশা মানসিকতা আমাকে এখনও স্পর্শ করতে পারে না। আর সমালোচনার কথা যেটা বললেন, তাও আমার ক্ষেত্রে পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান ছিল। বিশেষ করে রেডিওতে যখন আমি গান করা শুরু করি তখন সমালোচনার তীব্র তীর আমাকে জর্জরিত করেছে কিন্তু ব্যথিত হইনি। আমার ধারণা, একাডেমিকভাবে আমি শিক্ষাগ্রহণের স্বাভাবিক সুযোগটুকু থেকে বঞ্চিত বলে অনেকেই আমার ভুল ধরতে তৎপর ছিল। আমার মনে আছে- সেই সব সমালোচনাকে বর্জন না করে আমি সবসময় যুক্তিযুক্ত অংশটুকু গ্রহণেই বেশি মনোযোগী ছিলাম। সে কারণে এখন বুঝি- রেডিওর সেই এক যুগেরও বেশি সময়ে আমার সগোত্রীয় বন্ধুরা ভুল ধরতে গিয়ে আমাকে আরও বেশি মহৎ করে তুলেছে। ওরা শত্রুতা করতে গিয়ে বড় বন্ধুর মতো কাজটি করে দিয়েছে। আর সে কারণেই বোধকরি আমি যত বেশি নিজেকে ছাত্রজ্ঞান করি, লোকে তত বেশি আমাকে পণ্ডিত ভাবতে পছন্দ করে।
প্রশ্ন : সাধারণত গুরু-শিষ্য কিংবা তালিমের একটি যোগসূত্রিতা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বড় একটি ফ্যাক্টর বলে ধারণা করা হয়। যদিও আপনার জীবন সংগ্রামের গল্পটিও অনেকখানি আলাদা। তবুও জানতে চাই গুরুসৌভাগ্যের কোন দৃষ্টান্ত আপনার সঙ্গীত জীবনে ঘটেছে কি?
উত্তর : আপনি ঠিকই বলেছেন- তালিম কিংবা গুরু-শিষ্যের যোগসূত্রিতা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বড় একটি বিষয়। তবে আমার জীবনের ঊষালগ্নে তালিমের তেমন সৌভাগ্য হয়নি। তাছাড়া মনে রাখা দরকার এটি একটি স্বাভাবিত প্রক্রিয়াগত ধারা। আর আমার জীবনে স্বাভাবিক অনেক সুযোগই অনুপস্থিত ছিল। সে কারণে বহু বার বলেছি, প্রকৃতিই আমার বড় শিক্ষক। আমার লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে পথিকের মতো অভিজ্ঞতার ঝোলা বয়ে পথে প্রান্তরে ঘুরেছি। যেখানে যতটুকু পেয়েছি আমি তা সংরক্ষণ করেছি। অবিরাম এই চলার পথে মাত্র ১০ বছর বয়সে আমি সঙ্গীতের মোটামুটি সব আয়ত্ত করে ফেলি। জীবনের কোন এক বাকে এক দিন গ্রামোফোনে ক্লাসিক্যাল গানের একটি রেকর্ড শুনে আমি অস্থির হয়ে পড়ি। আমি হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করি এ গান কোথায় পাওয়া যায়। একপর্যায়ে হবিগঞ্জ জেলার সল্লা থানার আজমিরীগঞ্জে উস্তাদ কালী প্রসন্ন মোহন চক্রবর্তীর সন্ধান পাই। উনার কাছে আমি তিন মাস শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছি। তারপর তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘বাবারে আমার কাছে যতটুকু ছিল তা আমি তোমাকে দিয়ে দিয়েছি- আর আমার কাছে শিখতে চেও না।’ এ রকম আকর্ষিকভাবে তাঁর কাছেই আমার প্রথম শাস্ত্র সঙ্গীত এবং তবলার পদ্ধতিগত হাতেখড়ি। এরপর রেডিও আমার গুরু। ১৯৬৭ সালে তবলা বাদক এবং খেয়ালি গায়ক হিসেবে নজরুল সঙ্গীতে আমি রেডিওতে যোগ দিই। রেডিওতে যোগ দেয়ার পর তৎকালীন শাস্ত্র সঙ্গীতের যত কনফারেন্স হতো তার কোনটিও আমি মিস করতাম না। এভাবেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি স্পষ্ট ধারণা আমার দখলে চলে আসে। আর একজন পণ্ডিতের কথা না বললেই নয়। বাহ্মণবাড়িয়ার উদাস চন্দ্র রায় নামে এক পণ্ডিত- তাঁর কাছে দীর্ঘ ১২ বছর আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছি।
প্রশ্ন : আপনার সঙ্গীত সাধনায় ঘরছাড়ার চমৎকার একটি উপলদ্ধির কথা সকলের জানা। কোন প্রেক্ষিতে আপনি পল্লীস্থান ছেড়ে সুরের সন্ধানে শহুরে পথের অজানা উপত্যকায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। আপনার পরিবার কি সহজেই বিষয়টি গ্রহণ করেছিল?
উত্তর : আমার জীবনের বেশকিছু সিদ্ধান্ত আমার ভাগ্যকে প্রসন্ন করেছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে- আমি যখন বাড়িতে কৃষি কাজ করে রাতের বেলায় সুরারাধনা করতাম। তখন এক সময় পল্লী পাড়ায় আমার দারুণভাবে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তখন আমার মনে হলো, এবার আমার অন্যকিছু করা দরকার। একপর্যায়ে আমি বাবাকে বললাম, বাবা- এভাবে তো আর জীবন চলবে না, আমি গান শিখতে ঘর ছাড়তে চাই। তিনি আমাকে হাসি মুখে অনুমতি দিয়ে বললেন- ‘আমার কোন বাধা নেই বাবা, তোর যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারিস।’ তারপর প্রথম আমি গানবাজনার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে উঠি আজমিরীগঞ্জের বন্দরে।
প্রশ্ন : আপনার সঙ্গীত জগতের উত্থান পর্বের উল্লেখযোগ্য কিছু যদি জানতে চাই।
উত্তরা : ১৯৪৭ সালের পর পল্লীগানের পরিসর ছেড়ে আমি প্রথম রামপুরে একটি যাত্রাদলে যোগ দিই। যেখানে আমি অন্য এক দুনিয়ার সন্ধান পাই। সেই রামপুরকে আমি আমার জীবনের তীর্থস্থান বলে জ্ঞান করি। এরপর আজমিরীগঞ্জের বেশকিছু এলাকায় আমি অবস্থান করি। এখানেই তবলা বাদক, ড্যান্স মাস্টার এবং অভিনয়ের শিক্ষক হিসেবে অল্প দিনের মধ্যেই আমার বেশ সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ১৯৫৬ সালে টিউশনির মাধ্যমে পেশাদারি গানবাজনা শুরু করি। এটা ছিল আমার জীবনের অন্যতম একটি স্মরণীয় ঘটনা। এখান থেকেই আমার জীবনের নতুন একটি বাক শুরু হয়। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রফেশনাল একটি যাত্রাদলে যোগ দিই। এখান থেকে বহু জায়গা ভ্রমণ করার লোভ আমাকে আকৃষ্ট করে। তাই পূর্বের যাত্রাদলের ২০০ টাকার চাকরি ছেড়ে মাত্র ৭১ টাকার এই চাকরিটা গ্রহণ করি। এটা ছিল আমার জীবনের উত্থানপর্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যয়। এই যাত্রাদলের উপর নির্ভর করে আমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব ক’টি জেলা ভ্রমণ করি। এ সময় গ্রামগঞ্জের বহু গুণী শিল্পের সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়। এখানেই বিখ্যাত যাত্রাভিনেতা অমলেন্দু বিশ্বাসের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে।
প্রশ্ন : সিলেটে ‘সঙ্গীত পরিষদ’ নামে আপনার একটি সঙ্গীতশিক্ষার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার পেছনে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কোন চিন্তাটি কাজ করেছে? এ সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।
উত্তর : আপনি ঠিকই বলেছেন প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার পেছনে বাস্তব একটি সমস্যা কাজ করেছে। আমি যখন রেডিও ছেড়ে টিউশনি শুরু করি তখন বাসায় বাসায় ক্লাস নিতাম। এক পর্যায়ে লক্ষ্য করলাম প্রায়ই ছাত্রছাত্রীর বাবা মা তাদের ছেলেমেয়েকে উদ্দেশ করে অনুরোধ করত- ‘মাস্টার মশাই ওকে ভাল একটি গান শিখিয়ে দেন- অনুষ্ঠানে গাইবে।’ আমি চিন্তা করলাম এটাত একটা বড় সমস্যা। সেই চিন্তা থেকেই ‘সঙ্গীত পরিষদ’ নামে এই স্কুলটির জন্ম। আমার প্রাণের এই প্রতিষ্ঠান থেকে অসংখ্য ছেলেমেয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে বিদেশে আলো ছড়াচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অসংখ্যবার পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছেন। ১৯৯৫ সালে সিলেটে এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই আমরা আয়োজন করেছিলাম জাতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলন।
প্রশ্ন : সঙ্গীত জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আপন লক্ষ্যে আপনি পৌঁছেছেন। এক সময় যাত্রাদলে গান করেছেন তারপর রেডিওতে সুযোগ পেলেন। অথবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক হিসেবেও আপনি যথেষ্ট প্রসারিত। সুযোগের এই নৌকগুলো ঠিক কিভাবে আপনার জীবনতীরে নোঙর ফেলল? আকর্ষিক কোন ঘটনা কি ঘটেছিল নাকি নিজস্ব উদ্যোগেই এটা সম্ভব ছিল?
উত্তর : আমি যাত্রাদলের তবলাবাদক হিসেবে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। সেই অনুষ্ঠানে আমি তবলা বাজাচ্ছি এবং লক্ষ্য করছি- দর্শকদের সামনের সারিতে শেরওয়ানি ও কলিদার পাঞ্জাবি পরা বেশ আভিজাত্যপূর্ণ রুচিশীল কয়েকজন ভদ্রলোক আমাকে খেয়াল করছেন। অনুষ্ঠান শেষে তাঁরা আমাকে বলল- ‘অনেক ভাল বাজিয়েছ, এবার রেডিওতে চেষ্টা কর। এখানে তোমার শেখার আর তেমন কিছু নেই।’ সে সময়কার অত্যন্ত গুণী এই লোকগুলো ছিলেন- দীন আলী মিয়া, সঙ্গীত পরিচালক খালেদ হোসেন খান, বাহাদুর খান এবং সমর দাশ। তাঁদের সেই উৎসাহ আমাকে রেডিওতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়। এরপর রেডিও থেকে মাত্র কয়েক বছর পরেই চাকরি ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে আসি। সে সময় অনেকেই আমাকে বলেছিল ‘তুমি কি পাগল নাকি, লোকে রেডিওতে চাকরি পায় না আর তুমি চাকরি ছেড়ে দিলে!’ আমি তখন জবাবে বলেছিলাম, আগে তো বের হই তবে সময়েই কথা বলবে। এরপর আশির দশকে আমি সিলেটে একটি গানের স্কুল শুরু করি। এরপর যাদের সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছি তাদের নাম না বললেই নয় মুক্তার দবীর উদ্দিন চৌধুরী, জসিমউদ্দীন এ্যাডভোকেট, কন্টাক্টর সোস্তফা চৌধুরী, রামচন্দ্র ভট্টাচার্য এবং সিলেটের তৎকালীন সংস্কৃতি অঙ্গনের সেইসব ব্যক্তিত্ব যাদের অপার স্নেহ-সহযোগিতায় আজকের আমি রামকানাই দাশ। তারা আমাকে অত্যন্ত প্রিয়জনের মতো লালন করেছে। আমি তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন : লোকে আপনাকে পণ্ডিত বলে জানে। এর পেছনের গল্পটি জানতে চাই- কখন এবং কিভাবে এই উপাধি আপনার নামে সঙ্গে যুক্ত হল?
উত্তর : এটা প্রাতিষ্ঠানিক কোন উপাধি নয় এবং এ ধরনের উপাধি প্রদানের কোন প্রতিষ্ঠান আছে বলেও আমার জানা নেই। মূলত মানুষ আমাকে ভালবেসেই নামে শুরুতে পণ্ডিত যোগ করেছে। এর পেছনের কোন গল্প নেই। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কোন এক মঞ্চ থেকে প্রবীণ রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে নাকি ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্বোধন করেছিলেন। সেই থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটির প্রচলন শুরু। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটি ঘটেছে।

৯.
জীবন আর সংগীতকে একাকার করে দেখা, যাপন করা প্রকৃত শিল্পীর দেখা মেলা ভার এ জগত সংসারে। কিন্তু তাই বলে তারা দুর্লভ নন বলেই মনে ভাসে পণ্ডিত রামকানাই দাশের মুখচ্ছবি। কারণ মানবিক মানুষ হিসেবে সমাজে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের, হতদরিদ্র প্রাকৃতজনের সন্তানদের সংগীত শিক্ষায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন পণ্ডিত রামকানাই দাশ। তিনি যেমন লোকগানের চর্চা করছেন, তেমনই সমানতালে গরিবদের ছেলেমেয়েদের জন্য চালু করেছেন বিনে পয়সায় গানের ক্লাস। এ ধরনের নি:স্বার্থ বিলিয়ে দেওয়া রামকানাই দাশের মতোন মাটির সন্তানকেই মানায়। আপনার প্রতি রইল অসীম শ্রদ্ধা ।

(তথ্যসূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দৈনিক জনকণ্ঠ, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২ এবং ২৫ জুলাই ২০১৪)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত