প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

ফিরোজা বেগম

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:২১

১.
নজরুল সংগীতের প্রসঙ্গ এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফিরোজা বেগমের ছবি। সংগীতের নিমগ্ন ধ্যানী এই শিল্পী সঙ্গীতকে পৌঁছে দিয়েছিলেন উপাসনার স্তরে। সঙ্গীতের সব শাখাতেই ছিল তাঁর অনায়াস বিচরণ। বাংলা গানের সবচেয়ে বর্ষীয়ান এ শিল্পী দীর্ঘ পরিক্রমায় ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। আমাদের দেশে যারা সঙ্গীত চর্চা করেছেন, যারা নজরুলসঙ্গীতকে একটা উচ্চ মার্গে নিয়ে যাওয়ার সাধনায় সিদ্ধ হতে পেরেছিলেন, ফিরোজা বেগম তাদের অন্যতম। আধুনিক ও ধ্রুপদ সঙ্গীত- উভয় ধারাতেই তার অধিকার ছিল এবং সে জন্যই তিনি নজরুল সংগীতের একটা মাত্রা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তার সুমিষ্ট কণ্ঠে। ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।’লোক চোখের আড়ালেই ছিলেন, গত বছরের আজকের দিনেই চিরতরে চলে গেছেন কিংবদন্তিতুল্য নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফিরোজা বেগম। কিন্তু বাংলার মানুষের হূদয়ে সুরের ধারায় চিরকাল অন্য এক উচ্চতায় বিরাজ করবেন এই গানের পাখি, ভুলতে দেবেন না তাঁকে। ফিরোজা বেগম ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। প্রিয় শিল্পীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ফিরোজা বেগমের জন্ম ১৯৩০ সালের ২৮ জুলাই ফরিদপুরে।

২.
নজরুল সংগীতের সুর কোথাও থেকে ভেসে এলেই নজরুলের পর যার মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে শ্রোতার মনের আকাশে, তিনি উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী ফিরোজা বেগম। সংগীতের সব শাখাতেই অবাধ বিচরণ ছিল তাঁর। যিনি সাত দশকেরও বেশি সময় কাটিয়ে ব্যক্তি থেকে পরিণত হয়েছিলেন ইন্সটিটিউটে। সবার কাছে আইকন হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। সেই সংস্কৃতি জগতের মহীরুহ ফিরোজা বেগম ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার রাত ৮টা ২৬ মিনিটে রাজধানীর এ্যাপোলো হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে উপমহাদেশীয় সংগীতের এই সম্রাজ্ঞীর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। ফিরোজা বেগমের হৃদযন্ত্র ও কিডনি স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিল না। পাশাপাশি ধরা পড়েছিল জন্ডিস। সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পরদিন বনানি কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয় । ফিরোজা বেগম ছিলেন নজরুল সংগীতের কিংবদন্তীতুল্য শিল্পী এবং আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের এক উজ্জ্বল তারকা। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের সংগীত ও সাংস্কৃতিক জগতে যে শুন্যতা সৃষ্টি হয় তা সহজে পূরণ হবার নয়।

৩.
ফিরোজা শুধু নজরুল সাধকই ছিলেন না, ছিলেন দেশের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এক শিল্পী। পাকিস্তান আমলে ইসলামাবাদ রেডিওর উদ্বোধন হবে। গান গাইতে ডাক পড়ল ফিরোজা বেগমের। তিনি জানালেন, আগে বাংলা গান গাইতে দিতে হবে, না হলে গাইবেন না। তখনকার তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন ওই শর্তেই রাজি হন। তিনি গাইলেন- ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’। সত্তরে পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠেছে স্বাধিকার আন্দোলনে, আর সে সময় করাচিতে ইএমআই পাকিস্তানে তিনি ‘জয়, জয়, জয় বাংলার জয়’ আর ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ এই বাংলা গানগুলো রেকর্ড করেন। এই গান গাওয়ার অপরাধে হেনস্থা হতে হয় তাঁকে। দেশে ফেরার পর একদিন রেডিও স্টেশন থেকে তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর গভীর রাতে নামিয়ে দিয়ে যায় বাসায়। তবে গানের মূল রেকর্ড ধ্বংস করে ফেলা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একাধিকবার তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। ১৪ ডিসেম্বর একটুর জন্য বেঁচে যান মৃত্যুর হাত থেকে।

৪.
গানের জন্য যার এত নামডাক ভারতজুড়ে, সেই তিনি ১৯৭২ সালের আগে কখনোই মঞ্চে ওঠেননি। ১৯৭২ সালের ২৭ অক্টোবর কলকাতার রবীন্দ্রসদনে তিনি গান করেন। সেটাই ছিল সেখানে কোনো শিল্পীর করা প্রথম একক অনুষ্ঠান। সারা বিশ্ব তিনি পরিভ্রমণ করেছেন নজরুলের গান নিয়ে। একক অনুষ্ঠান করেছেন ৩৮০টির মতো। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রহে তাঁকে নজরুল সংগীত ও অতুল প্রসাদের গান শিখিয়েছেন ফিরোজা। এই আকাশছোঁয়া খ্যাতি তাঁকে কখনোই অহংকারী করে তোলেনি। খ্যাতিকে তিনি সব সময়ই নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখেছেন। কখনোই বিত্তের পেছনে ছোটেননি। এ জন্যই তিনি পরম আত্মবিশ্বাসে বলেছেন, ‘আমি আছি আর আছে আমার তানপুরা।’নজরুল প্রসঙ্গে শিল্পী ফিরোজা বেগম বলেছিলেন, ‘নজরুল মানবসাধক। বিরল এই সাধকের সান্নিধ্য আমার জীবনের প্রধান স্মৃতি ও প্রেরণা। তাঁর কাছ থেকে গান শিখে আমি প্রবেশ করেছি বাংলা সংগীতের ঐশ্বর্যময় ভুবনে। নজরুলসংগীত আমাকে দিয়েছে নতুন জগতের সন্ধান, যে জগৎ মানবিক সৌন্দর্যে ভরপুর।’

৫.
ফিরোজা বেগমের জন্ম ১৯৩০ সালের ২৮ জুলাই ফরিদপুরে। ছোটবেলায় সব কিছুর মধ্যেও গান শোনার এক অদ্ভুত নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। পারিবারিক আবহে গান শেখার অবকাশ না থাকলেও বাবা-মায়ের সংগীতপ্রীতি ছিল। এটাই ছিল শুধু সহায়ক। গানের নেশা পেয়ে বসে তাকে। স্কুলের ছুটিতে ছোট মামা আর চাচাতো ভাইদের সঙ্গে যান কলকাতায়। মামার উৎসাহে সঙ্গীতরসিক মহলে গান শোনাতে শুরু করেন। তিনি গেয়ে শোনালেন ‘যদি পরানে না জাগে আকুল পিয়াসা’। ছোট্ট মেয়েটার গায়কীতে মুগ্ধ সবাই। একদিন গুণীজনদের মজলিসে গান শুনিয়ে দারুণ তারিফ পেলেন। তাঁকে আদর করে পাশে বসালেন বাবরি দোলানো একজন ব্যক্তি। জানতে চাইলেন, ‘এ গান তুমি শিখলে কেমন করে’ তিনি জানালেন, ‘রেকর্ড শুনে নিজে নিজেই শিখেছি।’ শুনে তো সবাই অবাক। বাসায় ফিরে মামা জানালেন, আসরের মধ্যমণি হয়ে বসেছিলেন বিখ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনিই কথা বলেছিলেন তাঁর সঙ্গে। ফিরোজা বেগম তখন নজরুলকে চিনতেন না। সে যাত্রায় কলকাতা ভ্রমণের এক অদ্ভুত আনন্দ নিয়ে ফিরলেন ফরিদপুরে। স্থায়ীভাবে কলকাতায় থাকতে না পারাটা তাঁর গান শেখার পথে বাধা হয়ে দেখা দেয়। তবে এর ফাঁকে ফাঁকে নজরুলের সান্নিধ্যে গান শেখার সুযোগও মিলেছিল তাঁর। শৈশবে ফিরোজা বেগম শৈশবে ছিলেন অন্তর্মুখী স্বভাবের। পড়ালেখা, খেলাধুলা, গান, অভিনয়, আঁকাআঁকি, নাচ সবকিছুই করেছেন। আর সে কারণেই সাফল্য সব সময় তার কাছে কাছেই থেকেছে। অথচ তাকে কেউ কিছুই শেখাননি। যা শিখেছেন, নিজে নিজেই। কখনও ভুল হলে নিজেই শুধরে নিয়েছেন। রক্ষণশীল বাড়ি না হলেও তাদের বাড়িতে গানের চর্চা ছিল না। সে সময়ে মেয়েদের পড়াশোনা, স্কুলে যাওয়ার চলই ছিল না। সেই পরিবেশে গান শেখার অবকাশ না থাকলেও মা-বাবার সঙ্গীতপ্রীতির কারণে প্রচুর গান শোনা হয়েছিল তাঁর।

৬.
১৯৪২ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ইসলামী গান নিয়ে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয়। বিখ্যাত সুরসাধক চিত্ত রায়ের তত্ত্বাবধানে ছোট্ট ফিরোজা গাইলেন ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’। এতেই বাজিমাত। বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে সব রেকর্ড বিক্রি হয়ে যায়। সংগীতপ্রেমীদের সঙ্গে সুরের আকাশের এই তারার সেটাই প্রথম পরিচয়। ছোট্ট মেয়েটির গায়কী সংগীতবোদ্ধা ও সাধারণ শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। এর কিছুদিন পর নতুন গানের জন্য চিঠি দিয়েছিল গ্রামোফোন। এবার আর ইসলামী গান নয়, কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে উর্দু গান। সঙ্গীতজগতের এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুরকারের হাত ধরে গাইলেন ‘ম্যায় প্রেম ভরে, প্রীত ভরে শুনাউ’ ও ‘প্রীত শিখানে আয়া’। তখন সুরস্রষ্টার সঙ্গে শিল্পী জীবনের অনন্য এক মেলবন্ধন ঘটান। এরপর কীর্তিমান সুরকার কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে উর্দু গানের রেকর্ড করলেন। বের হলো দ্বিতীয় রেকর্ড। এই রেকর্ড প্রকাশের মাধ্যমে কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে ফিরোজা বেগমের পরিণয়ের সূত্রপাত। ফিরোজা বেগম সঙ্গীত জীবনের মূল শিক্ষাটাই পেয়েছেন ভারতবর্ষের ক্ষণজন্মা এই সুরকারের কাছ থেকে। রেডিওতেও তিনি নানা ধরনের গান গেয়েছেন। তত দিনে তিনি রবীন্দ্রসংগীত আর আধুনিক গানেও সমানভাবে বিখ্যাত। দু-দুবার আধুনিক গানের ক্ষেত্রে মাসের সেরা শিল্পী হয়েছেন। ফিরোজা বেগমের গলায় রবীন্দ্রসংগীত শুনে গান শেখানোর জন্য পঙ্কজ মল্লিকের মতো শিল্পী তাঁর কলকাতার বাড়িতে চলে আসেন। গুণী শিল্পীরা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অন্যদিকে তিনি আব্বাসউদ্দীন ও পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কাছে অল ইন্ডিয়া রেডিওর জন্য মাঝে মাঝে লোকগীতির তালিম নিচ্ছেন। রেডিওর পাশাপাশি স্টুডিওতেও গানের রেকর্ড হচ্ছে। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর তত্ত্বাবধানেও গানের রেকর্ড হলো। তখন চৌদ্দ-পনেরো বছরের কিশোরী।

৭.
তবে নানা গানের ভিড়ে নিজেকে আলাদা করে নেওয়ার এক তীব্র ইচ্ছা কাজ করে তাঁর মধ্যে। সিদ্ধান্ত নিলেন অন্য গান নয়, নজরুলের গানই গাইবেন। গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তারা অবাক। ফিরোজার সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বললেন তাঁরা। কিন্তু ফিরোজা সিদ্ধান্তে অবিচল। নজরুল সংগীতই হয়ে উঠল তাঁর ধ্যান ও জ্ঞান। এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করলেন। তখন নজরুল সংগীত বলা হতো না, বলা হতো আধুনিক গান, লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। মূলত ফিরোজা বেগমের চেষ্টাতেই তা পায় নজরুলগীতির অভিধা। তাঁর অনড় ভূমিকার কারণেই অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও নজরুলের গান বাধ্যতামূলক হয়। ১৯৪৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁর গলায় নজরুলের গানের প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করে। ১৯৬০ সালে পূজা উপলক্ষে প্রকাশিত রেকর্ডে ফিরোজা গাইলেন সর্বকালের জনপ্রিয় দুটি গান ‘দূর দ্বীপবাসিনী’ আর ‘মোমের পুতুল’। ফিরোজার জনপ্রিয়তাকে আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।

৮.
১৯৪৮-৪৯ সালে ফিরোজা বেগম আর তালাত মাহমুদকে অতিথি শিল্পী হিসেবে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। আর তাঁদের গানেই উদ্বোধন করা হয় ঢাকা রেডিওর শর্ট ওয়েভ। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ টানা ১৩ বছর ছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৬ সালে সুরকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি তাঁর পরিবার। কিন্তু নিজের সত্যকেই তিনি সব সময় অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কলকাতাতেই জন্মেছে তাঁর তিন সন্তান- তাহসিন, হামীন ও শাফীন। শিল্পীর তখন স্বর্ণযুগ। অথচ টানা পাঁচ বছর স্বামী-সন্তান-সংসার সামলাতে গিয়ে গান গাইতে পারেননি তিনি। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন কমল দাশগুপ্ত। ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই পিজি হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। মাত্র ১৮ বছরের সুরময় দাম্পত্যজীবনের ইতি ঘটে। ১৯৭৪ সালে তিনি বিয়ে করেন আরেক সঙ্গীতজ্ঞ মনসুর আহমেদকে। তিনিও সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করেছেন। তার তিন ছেলে তাহসিন, হামীন ও শাফিন আহমেদ। হামীন ও শাফিন আহমেদ দুই ভাই-ই দেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র।

৯.
নজরুল সংগীতকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেয়ার পেছনে রয়েছে তার অসামান্য অবদান। বিদ্রোহী কবির গানকে ‘নজরুল সংগীত’ নামকরণের পেছনে তিনি রেখেছেন ভূমিকা। তার গান দিয়েই প্রথম নজরুল সংগীতের একক লং-প্লে প্রকাশ শুরু করে। কবি নজরুল অসুস্থ হওয়ার পর ফিরোজা বেগমই নজরুল সংগীতের প্রথম স্বরলিপিকার। নজরুল সংগীতের শুদ্ধ স্বরলিপি ও সুর সংরক্ষণের জন্য তাকে করতে হয়েছে কঠিন সংগ্রাম। নজরুল ইন্সটিটিউট তৈরি হয়েছিল তারই ভাবনায়, যদিও শেষ পর্যন্ত সেই ইন্সটিটিউটে জায়গা হয়নি তার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত ৩৮০টির বেশি একক অনুষ্ঠানে গান করেছেন তিনি। নজরুল সংগীত ছাড়াও তিনি গেয়েছেন আধুনিক গান, গীত, গজল, কাওয়ালি, ভজন, হামদ ও নাত। এ পর্যন্ত তার ১২টি এলপি, চারটি ইপি, ছয়টি সিডি ও ২০টির বেশি অডিও ক্যাসেট বেরিয়েছে। নজরুল সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশে-বিদেশে পেয়েছেন নানা পুরস্কার- স্বাধীনতা পদক (১৯৭৯), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি স্বর্ণপদক, শ্রেষ্ঠ টিভি শিল্পী পুরস্কার (পাকিস্তান ও বাংলাদেশ), স্যার সলিমুল্লাহ স্বর্ণপদক, দীননাথ সেন স্বর্ণপদক, বাসচাস পুরস্কার, সেরা নজরুলসঙ্গীত শিল্পী পুরস্কার (টানা কয়েকবার), সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র পুরস্কার, নজরুল আকাদেমি পদক ইত্যাদি। এছাড়াও জাপানের অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিবিএস থেকে পেয়েছেন গোল্ড ডিস্ক।
 
১০.
নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান যথার্থই বলেছেন : শৈশব থেকেই তিনি নজরুলের সান্নিধ্যে আসেন এবং পরবর্তীকালে নজরুল তার বিশেষ আরাধ্য ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। নজরুলের সংগীতের ধারায় বিশেষ কোনো গায়কী রূপ ছিল না। তার কারণ, এ বিষয়ে ছিল নজরুলের উদারতা। তিনি কণ্ঠ অনুযায়ী সংগীতের রূপায়ণে বিশ্বাসী ছিলেন। অর্থাৎ তিনি কণ্ঠের বৈশিষ্ট্যকে সংগীতে গ্রহণ করতেও রাজি ছিলেন। এ কারণে যূথিকা রায়, আরডি বর্মণসহ অনেকেই নজরুলের সুরে গান গেয়ে বিপরীতধর্মী কণ্ঠধারাতেও সুনাম অর্জন করেছিলেন। ফিরোজা বেগম সেক্ষেত্রে অবশ্য ছিলেন ব্যতিক্রমী। তিনি নজরুলের সুরকে নিজের কণ্ঠে ধারণ করে সুমিষ্টতায় ও কারুকার্যতায় পূর্ণতর করেছিলেন। নজরুলের সংগীতের একটা আশাপ্রদ রূপ তিনি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ কারণে তিনি যখন নজরুলের গান রেকর্ডে ধারণ করেন, তখন নজরুল সংগীত একটা বিশিষ্টতায় প্রকাশিত হয়। নজরুল সুরের ক্ষেত্রে মৌলিকতা, আধুনিকতা এবং হৃদয়ের মধুময় আবেগ ঢেলে রবীন্দ্রনাথসহ পঞ্চকবির গানের জগৎ থেকে ভিন্ন হয়ে ওঠেন। এটি অনেক গায়কের পক্ষেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সমসাময়িককালে যারা নজরুলের গান করেছেন, এমনকি ক্লাসিক্যাল ধরনের গান যারা করতেন যেমন- আঙ্গুরবালা, কমল ঝরিয়া- তাদেরও তিনি যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতেন। এরকম গল্প আছে- যখন আঙ্গুরবালাকে তার প্রথম গানটি শেখান- শেখানোর পরে তিনি তাকে বলেছিলেন- নানী আমার মতন করে আমি শেখালাম- তুমি এখন পান খাওয়া মুখের মিষ্টি রস লাগিয়ে এটাকে তোমার মতো করে গাও। এ ধরনের বিষয়গুলো নজরুলের গানের রূপায়ণে সব সময় সুফল আনেনি। নজরুলের গান বিচিত্র ধরনের হতো- সেক্ষেত্রে তিনি নিজেকে বলতেন, বাণীর কমল বনে তিনি এক বনমালী। এর ফলে তার গান হয়ে উঠত একই সঙ্গে সুরের সুরধ্বণী এবং বাণীর শিল্পিত মিশ্রণ। নজরুল সংগীত চর্চার ক্ষেত্রে ফিরোজা বেগম এক আবশ্যকীয় অবলম্বন। তিনি একই সঙ্গে তার কণ্ঠে নজরুলের সুর ও বাণীর সহজ-স্বাভাবিক ও সৃষ্টিশীল উন্মীলন ঘটিয়েছিলেন। নজরুল বলতেন, ইন্দ্রধনু যেমন সূর্যের সাতটি কাব্য- নিজে অগ্নিদগ্ধ হয়ে এই ইন্দ্রধনুর সৃষ্টি হয়েছে- আমার গানও তেমনি সুরের ইন্দ্রধনু। নজরুলের সংগীতে যে বেদনা, যে বিরহবোধ এবং একই সঙ্গে সুন্দরের অসীম ক্ষুধা- তা শিল্পিত করে তুলেছিল তাকে আপনার বোধে এবং সৃষ্টিগত উপলব্ধিতে ফিরোজা বেগম তাকে মহিমাময় করে তুলেছিলেন। নজরুল সংগীতের মূল উদ্দেশ্য অভিজ্ঞতার শিল্পিত প্রকাশ, শুধু সৃষ্টির জন্যই সৃষ্টি নয়। সেই সঙ্গে পরম সাম্য, সুন্দরের ধ্যান এবং রসলোকের তৃষ্ণা- যে চির সত্যের অভিসারে অভিগমন করেছিল- ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে নজরুলের গীত যেন তারই প্রস্ফুটিত ধারা।

১১.
তার শিল্পীসত্তার আরেক উপাদান তার অনমনীয় ব্যক্তিত্ব। কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করা তার স্বভাবজাত ছিল না। তাই নানা সময়ে তিনি ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছেন। স্বামী প্রখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্ত কেন্দ্রিক নানা সমালোচনার ঝড় তাকে সহ্য করতে হয়েছে।কিন্তু ইতিবাচক দিকটি এই যে, সবকিছু সত্ত্বেও তিনি সর্বমহলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছেন। বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পীদের মধ্যে তার ক্ষেত্রেই সর্বাগ্রে সর্বজনশ্রদ্ধেয় অভিধাটি প্রযোজ্য বলে মনে করি। তাকে সম্মান জানিয়ে তার স্মৃতিতে এমন একটি পুরস্কার প্রবর্তন করা যায়, যা হবে নজরুল সংগীত চর্চার জন্য শ্রেষ্ঠ সম্মান ও স্বীকৃতি।

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত