আমি স্বাপ্নিক নিয়মে এখানেই থাকি

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:৩৬

‘আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা -
সারা দেশে।’

এই কবিতার মতই তিনি সারা দেশে আছেন। জন্ম শতবর্ষে এসে আবারো সে কথাই সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন। কবি আহসান হাবীব বাংলাদেশের বিশিষ্ট আধুনিক কবি যিনি দেশ বিভাগের আগেই সমকালীন কবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। বহুমাত্রিক প্রতিভায় আহসান হাবীব একাধারে কবি, সাংবাদিক এবং যশস্বী সাহিত্য সম্পাদক।

মধ্যবিত্তের সংকট ও জীবনযন্ত্রণা আহসান হাবীবের কবিতার মুখ্য বিষয়। সামাজিক বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংগ্রামী চেতনা এবং সমকালীন যুগ যন্ত্রণা তার কবিতায় শিল্পসম্মতভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। তার ভাষা ও প্রকাশ ভঙ্গিতে নাগরিক মননের ছাপ আছে।

আহসানে হাবীব বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশের প্রসঙ্গ অনুষঙ্গকে তার কবিতায় তুলে আনতে পেরেছেন চমৎকার কুশলতায়। সব রকম শোষণ-জুলুম, দুঃশাসন নির্যাতন তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। এসবকে দেখেছেন মানবিক ঔদার্য্য দিয়ে, অন্তরঙ্গ আলোকের নিভৃত ভূগোলে তিনি সময়ে ও অসময়ে মানুষকে জর্জরিত হতে দেখে ব্যথিত হয়েছেন, দুঃখের পংক্তিমালা সাজিয়েছেন।

আহসান হাবীব কলকাতায় ১৯৩৩-৩৪ সাল থেকে ১৯৪৯-৫০ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। বলতে গেলে তার সাহিত্যচর্চার স্বর্ণযুগ ছিল ওই সময়ই। বিশেষ করে ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এক দশক তিনি নিরলসভাবে লিখে গেছেন। জীবনের অধিকাংশ সেরা ও বিখ্যাত কবিতা ও গল্পগুলো তিনি লিখেছেন ওই সময়েই।

এ কথায় বলা যায়, আহসান হাবীব আমৃত্যু উত্তরণের এক একটি ধাপ পেরিয়ে তিনি আশির দশকের কবিদেরও প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েই তারুণ্যে উজ্জ্বল ছিলেন। ১৯৩৭ থেকে ‘৪৭ সাল পরিসরে বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ তথা অভাব-অনটন, দারিদ্র্য অবনতি ঘটায় সবকিছুর, বিশেষত নৈতিকতা, শালীনতা ও মানবতার। জীবন হারায় জীবনের বৈশিষ্ট্য। আহত পঙ্গু জীবনের এই ব্যর্থতা-হাহাকার তার কবিতায় স্থান লাভ করেছে। এ জন্য অনেক সমালোচক তাকে হতাশার কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

কবি দেখেছেন জীবন বার বার বদলে যায় এবং কাল থেকে কালে সে জীবন প্রবহমান। প্রবহমানতা না থাকলে শুকিয়ে যেতো জীবন। পুরনো হতে হতে স্থবির হয়ে যেতো স্পন্দনতা। আর সুন্দরতা না থাকলে জীবন জীবন থাকে না। ফলে জীবন ও প্রকৃতি একই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে আহসান হাবীবের কবিতায়। কদাকার জীবন ভাবনার শিল্পিত ভাষ্য হচ্ছে তার কবিতা।

কবি আহসান হাবীবের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি। জন্মস্থান ও পৈতৃক আবাস পিরোজপুরের শঙ্করপাশা গ্রামে। বাবা হামিজ উদ্দিন হাওলাদার এবং মা জমিলা খাতুন পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ আহসান হাবীব ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মৃদুভাষী, আত্মমগ্ন ও ভাবুক প্রকৃতির। নিসর্গের প্রতি তার ছিল প্রবল আকর্ষণ। শৈশবেই ভেতরে শেকড় গেড়েছিল কবিতার বীজ। ছাত্রজীবন থেকেই তার কবিতা লেখা শুরু হয়। প্রথম কবিতা ছাপা হয় পিরোজপুর সরকারি হাইস্কুল বার্ষিকীতে। কবিতার নাম ছিল ‘মায়ের কবর পাড়ে কিশোর’। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন ১৯৩৪ সালে। তারপর ভর্তি হন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কলেজের পড়াশোনার পাঠ শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত রাখতে হয় তাঁকে। বিএম কলেজে দেড় বছর পড়ার পর ১৯৩৬ সালের শেষার্ধে কাজের খোঁজে তিনি রাজধানী কলকাতায় পাড়ি জমান৷ এভাবেই কবি আহসান হাবীবের বরিশাল থেকে তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় পদার্পণ।

তারপর শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। ফজলুল হক শেলবর্ষী সম্পাদিত ‘দৈনিক তদবীর’ পত্রিকায় মাসিক ১৭ টাকায় শুরু করেন জীবনের প্রথম চাকরি। তারপর তিনি বিভিন্ন সময় দৈনিক আজাদ, মাসিক বুলবুল, পাক্ষিক শওগত, শিশু শওগত, দৈনিক কৃষক ইত্যাদি কাগজে কাজ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে এবং একই সঙ্গে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৪৭ সালে আহসান হাবীবের প্রথম কবিতায় বই  ‘রাত্রি শেষ’ প্রকাশিত হয় কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কমরেড পাবলিশার্স থেকে। ওই বছরই ২১ জুন তিনি বগুড়া জেলার নামাজগড়ের মহসীন আলী মিয়ার কন্যা সুফিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন। তাদের দুই পুত্র, দুই কন্যা। ১৯৫০ সালে তিনি কলকাতা থেকে দেশে ফিরে আসেন। ফিরে এসেই দৈনিক ইত্তেফাকে সাহিত্য পাতা সম্পদনা শুরু করেন। পাশাপাশি সম্পাদনা করেন সাপ্তাহিক প্রবাহ। এক সময় ‘কথাবিতান’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থাও গড়ে তোলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় তারই প্রকাশনা থেকে। অবশেষ ১৯৬৪ সালে যোগ দেন তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। আমৃত্যু অর্থাৎ ২১ বছর ধরে সফলভাবে তিনি ওই দায়িত্ব পালন করেছেন।

তার জীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। তিনি আগাগোড়া তার আদর্শ ধরে রেখেছিলেন নিপুণ মর্মশৈলী এবং একনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে। তার সময়ের তরুণদের কাছে তিনি ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়।

আহসান হাবীবের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৮টি। অন্যান্য লেখাসহ সব মিলিয়ে তার গ্রন্থের সংখ্যা ২৫। এর মধ্যে রয়েছে কাব্যগ্রন্থ- ‘রাত্রি শেষ’ ১৯৪৭, ‘ছায়া হরিণ’ ১৯৬২, ‘সারা দুপুর’ ১৯৬৪, ‘আশায় বসতি’ ১৯৭৪, ‘দুই হাতে দুই আদিম পাথর’ (১৯৮১), ‘প্রেমের কবিতা’ (১৯৮২) ও ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’ (১৯৮৫), কাব্যনুবাদ: ‘খসড়া’ ১৯৮৬, উপন্যাস: ‘অরণ্য নীলিমা’ ১৯৬২, শিশুসাহিত্য: ‘জোছনা রাতের গল্প’ ‘রাণী খালের সাঁকো, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ (১৯৭৭), ‘ছুটির দিন দুপুরে’ (১৯৭৮), অনুবাদ: ‘প্রবাল দ্বীপে তিন বন্ধু’ ‘অভিযাত্রী কলম্বাস’ (১৯৫৯), ‘রত্নদ্বীপ’, ‘রাজা বাদশা হাজার মানুষ’, ‘এসো পথ চিনে নিই’ ‘ইন্দোনেশিয়া’ (১৯৬৬), ‘ছোটদের পাকিস্তান’ ও ‘বোকা বোকাই’, সম্পাদিত গ্রন্থ : ‘বিদেশের সেরা গল্প’ ও ‘কাব্যলোক’ (১৯৬৮)।

কবি আহসান হাবীব বরাবরই ছিলেন নির্লিপ্ত অন্তর্মুখী এক মানুষ। বাংলা কবিতায় তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন একাধিক সাহিত্য পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬১), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪), নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), একুশে পদক (১৯৭৮), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পদক (১৯৮১), আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার প্রভৃতি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত