অশ্বিনীকুমার দত্ত

প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:১২

আধুনিক বরিশালের রূপকার মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন অন্যতম বিপ্লবী। তিনি আমৃত্যু রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে বরিশালবাসীর জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেছেন। দক্ষিণ বাংলার প্রাণ পুরুষ ১৮৮৪-১৯২৩ সাল পর্যন্ত আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটি শুধু বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদেরই মানুষ করেন নি, বরং সমাজের অনেক অশিক্ষিত, অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বাণ্ডুলে স্বভাবের বখাটে মুকুন্দদাসকে তিনিই দিনের পর দিন বাড়িতে ডেকে এনে আদর- স্নেহ-ভালবাসা ও সহচর্য দিয়ে এক নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। যে কারণে মুকুন্দদাস একসময় চারণ সম্রাট মুকুন্দদাস হতে পেরেছিলেন।

তাঁর পিতা ব্রজমোহন দত্ত একজন সাব-জজ ছিলেন। অশ্বিনীকুমার দত্তের মায়ের নাম প্রসন্নময়ী। প্রসন্নময়ী ছিলেন বানরীপাড়ার রাধাকিশোর গুহের মেয়ে। বাবার মতো মাও ছিলেন মানবতাবাদী ও দেশপ্রেমিক। ব্রজমোহন দত্ত ও প্রসন্নময়ীর পরিবারে ৪টি ছেলে ও ২ টি মেয়ের জন্ম হয়। অশ্বিনীকুমার দত্ত ছিলেন ওই পরিবারের বড় ছেলে।

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের জন্ম ১৮৫৬ সালের ২৫ জানুয়ারি। তৎকালীন বরিশাল জেলার পটুয়াখালী মহকুমা শহরে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলাধীন বাটাজোর গ্রামে।

পিতার সরকারি চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশুনা তাঁকে পূর্ববাংলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে সম্পন্ন করতে হয়। পিতার কর্মস্থল ঢাকা, ঢাকা থেকে দৌলত খা, রংপুর প্রভৃতি স্থানে পড়াশুনা করে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়ার যোগ্য হয়ে উঠেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ১৪ বছর। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে ১৭ বছরের নিচে কেউ পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার পেত না। তাই অশ্বিনীকুমার দত্তের বয়স বাড়িয়ে দিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়ে ওই কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে এফ এ ক্লাসে ভর্তি হন। এরপর তিনি এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে আইন পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ২৩ বছর বয়সে বি এ (১৮৭৮) এবং এক বছর বাদে এম এ পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি ১৮৭৯ সালে বি এল পরীক্ষা দেন এবং এ পরীক্ষায়ও  উত্তীর্ণ হন। ওই বছর তিনি শ্রীরামপুরের নিকটে চাতরা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।

মানবপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকার জন্য তিনি সুপরিচিতি লাভ করেন। সমাজের কল্যাণ এবং উন্নয়নের প্রতি গভীরভাবে নিবেদিত হয়ে তিনি বরিশাল শহরের মধ্যে নিজের দান করা এলাকায় ব্রজমোহন বিদ্যালয় (১৮৮৪) ও ব্রজমোহন কলেজ (১৮৮৯) প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ছাত্রদের শারীরিক এবং নৈতিক দিকসমূহ বিকাশের জন্য তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দীর্ঘ কুড়ি বছর বিনা বেতনে কলেজে শিক্ষাদান করেন। তিনি বরিশাল শহরে একটি বালিকা বিদ্যালয়ও (১৮৮৭) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর সারাজীবনের সহিষ্ণু সমাজসেবা তাঁকে স্থানীয় জনগণের কাছে খুবই প্রিয় করে তোলে। জনগণের সদিচ্ছা ও তাঁর পরিবারের সম্পদ ও প্রভাবের কারণে তিনি এমন জনসমর্থন লাভ করেন যা তাঁকে ১৯০৫-১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় সংকীর্ণ জেলা পর্যায় থেকে বৃহত্তর প্রাদেশিক রাজনৈতিক অঙ্গনে নিয়ে যায়। এ প্রক্রিয়ায় তিনটি স্থানীয় সংগঠন জনসমিতি (১৮৮৬), বাখরগঞ্জ হিতৈষিণী সভা (১৮৮৭) এবং নেত্রী সংঘ তাঁর সহায়ক হয়েছিল। এ সংগঠনগুলির তিনিই ছিলেন পথপ্রদর্শক এবং এগুলির কর্মকান্ডে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি বরিশাল পৌরসভার কমিশনার (১৮৮৫) হয়ে এর ভাইস চেয়ারম্যান (১৮৮৮) ও চেয়ারম্যান (১৮৯৭)-এর দায়িত্ব পালন করেন।

একজন কংগ্রেস সদস্য হিসেবে বরিশালে এক আলাদা সমর্থক গোষ্ঠী নিয়ে তিনি শহরের দ্বন্দ্ব-কলহ এবং উদারপন্থী ও চরমপন্থী দতন্দ্ব হতে নিজেকে সতর্কতার সঙ্গে দূরে রাখেন। অশ্বিনী দত্ত এ উদ্দেশ্যে তাঁর নেতৃত্বাধীন স্বদেশ বান্ধব সমিতির নামে গড়ে তোলা স্বদেশী স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যে বরিশালকে স্বদেশী আন্দোলন এর একটি শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। জেলার সর্বত্র এর ১৬০টিরও বেশি শাখা গড়ে উঠেছিল। ফলে তাঁকে বরিশালে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯০৮ সালে তাঁর সমিতির উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয় এবং ১৯১০ সাল পর্যন্ত তিনি লক্ষ্মৌ জেলে বন্দি থাকেন। তিনি স্বদেশী ব্যাংক, হিন্দুস্থান কোপারেটিভ ইন্স্যুরেন্স এবং কোপারেটিভ নেভিগেশন লিমিটেড প্রভৃতি স্বদেশী অর্থনৈতিক সংস্থাসমূহের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। স্বদেশ বান্ধব সমিতির মুখপত্র হিসেবে বরিশাল হিতৈষী প্রকাশের পেছনে তিনি সহায়ক ছিলেন।

১৯০৫ সালের অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন চলার সময় বরিশালের টাউন হলে অশ্বিনী কুমার দত্ত এক জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে জোরদার করা প্রসঙ্গে তার উপলব্দির কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন ‘আমরা যে সব বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছি, যদি কেউ তা যাত্রাপালা আকারে গ্রামে গ্রামে প্রচার করে, তাহলে তা আমাদের এরূপ সভা বা বক্তৃতার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হবে’।

গণসচেতনতা সৃষ্টির তাগিদে এ সময় অশ্বিনী কুমার দত্ত সংবাদপত্রের অভাব বিশেষভাবে অনুভব করেন। তাঁর চেষ্টার কারণে বিকাশ, স্বদেশী, বরিশাল, বরিশাল হিতৈষী প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বরিশাল হিতৈষী ও স্বদেশী পত্রিকা অসহযোগ আন্দোলনে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। এই পত্রিকা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও শিক্ষাবিস্তারে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হয়।

অশ্বিনী কুমারের একান্ত চেষ্টায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপিত হয়। জনপ্রিয়তার কারণে তিনি বরিশাল পৌরসভা ও লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এসময় তিনি একে ফজলুল হককে পৌরসভা ও জেলা বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত করেন। মূলত অশ্বিনী কুমারের হাতেই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি শুরু হয়।

অশ্বিনীকুমার দত্ত গণতান্ত্রিক অধিকার ও চেতনায় আস্থাবান ছিলেন। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সারা জীবন লড়াই করেছেন। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে- এ দাবির সমর্থনে তিনি ১৮৮৫-৮৬ সালে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক জনসভা করেন এবং আইনসভা বা পার্লামেন্ট গঠনের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। এ সময় তিনি ৪০ হাজার বরিশালবাসীর স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আইনসভা প্রতিষ্ঠার জন্য তা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রেরণ করেন।

অশ্বিনী কুমার ১৮৮৭ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সম্মেলনে ভারতে আইনসভা প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেন। ওই বছরই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি কংগ্রেসের আপসকামীতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণসর্বস্ব রাজনীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন। অশ্বিনী কুমারই প্রথম ব্যক্তিত্ব, যিনি সর্বপ্রথম কংগ্রেসের প্রাসাদ রাজনীতিকে জনগণের দোরগোড়ায় আনতে ব্রতী হয়েছিলেন।

ধার্মিক অশ্বিনীকুমার দত্ত ১৮৮২ সালে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন, যেমন- ভক্তিযোগ, কর্মযোগ, প্রেম, ভারতগ্রীতি ইত্যাদি। 

সূত্র: বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, বিপ্লবিদের কথা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত