তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০১৭, ১১:৩১

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। তার সব লেখায় মানুষের মহত্ত্ব ফুটিয়ে উঠেছে সাবলীলভাবে।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা-মায়ের নাম হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রভাবতী দেবী। বাল্যকালে পিতাকে হারিয়ে তিনি মা এবং বিধবা পিসিমার আদর-যত্নে লালিত-পালিত হন। 

লাভপুরের যাদবলাল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯১৬ সালে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করেন তারাশঙ্কর। সে সময় মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। ওই আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯২১ সালে তিনি এক বছর কারা অন্তরীণ থাকেন। ফলে তার শিক্ষাজীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটে। পরে তিনি পুরোপুরি কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে প্রায় এক বছর কারাবরণ করেন (১৯৩০)। স্বাস্থ্যভঙ্গ এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপের কারণে তার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। কারামুক্তির পর কিছুকাল গ্রামে কাটিয়ে ১৯৪০-এ বাগবাজারে একটি বাড়ি ভাড়া করে সপরিবারে কলকাতায় স্থায়ী হন। এরপর নিজেকে সাহিত্য সাধনায় নিয়োজিত করেন।

প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্করের প্রধান খ্যাতি। তার লেখায় বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের মাটি ও মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবনচিত্র, স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ব্যক্তির মহিমা ও বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্র-ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বে ধনতন্ত্রের বিজয় ইত্যাদি তার উপন্যাসের বিষয়বস্তু। 

সেখানে আরও আছে গ্রাম্যজীবনের ভাঙনের কথা, নগরজীবনের বিকাশের কথা। তার সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্পগ্রন্থ, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধের বই, ৪টি আত্মজীবনী এবং ২টি ভ্রমণ কাহিনী। 

১৯৫৫ সালে ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে চীন ভ্রমণ করেন। ১৯৫৭ সালে তাসখন্দে এশীয় লেখক প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় তিনি সফর করেন মস্কোও। অর্থের প্রয়োজনে শেষদিকে কিছুদিন দৈনিক সংবাদপত্রে কলাম লিখতেন। শেষ বয়সে কিছু ছবিও এঁকেছিলেন। তারাশঙ্করের উপন্যাস, গল্প ও নাটক নিয়ে চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ও তারাশঙ্করের জলসাঘর এবং অভিযান উপন্যাসের সফল চিত্ররূপ দিয়েছেন। তার যেসব রচনা চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে জলসাঘর ও অভিযান (১৯৬২), অগ্রদানী, আগুন, আরোগ্য নিকেতন, উত্তরায়ণ, কবি, কান্না, কালিন্দী, গণদেবতা, চাঁপাডাঙার বউ, জয়া, ডাকহরকরা, দুই পুরুষ, ধাত্রীদেবতা, ফরিয়াদ, বিচারক, বিপাশা, মঞ্জরী অপেরা, রাইকমল, শুকসারী, সন্দীপন পাঠশালা, সপ্তপদী, হার মানা হার, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, বেদেনী (২০১০) উল্লেখযোগ্য।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে— নিশিপদ্ম, বিচারক, ফরিয়াদ, কালিন্দী, গণদেবতা, আরোগ্য নিকেতন, রাধারানী, সপ্তপদী, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, কবি, ধাত্রীদেবতা,  চাঁপাডাঙার বৌ, নীলকণ্ঠ, জলসাঘর, বেদেনী, হারানো সুর, অভিযান, ডাকহরকরা, পঞ্চপুত্তলী, উত্তরায়ণ, মহানগরী, হীরাপান্না, গুরুদক্ষিণা; রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী, পথের ডাক, কালান্তর; নাটক দ্বীপান্তর, পথের ডাক, দুই পুরুষ। 

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কর্তৃক ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’, ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার’, পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন। এ ছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদেয় শরত্স্মৃতি পুরস্কার, জগত্তারিণী স্মৃতিপদক, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় দেহত্যাগ করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত