২০১৬ : সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যাঁদের হারালাম

প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:০৫

সাহস ডেস্ক

কেটে গেছে আরেকটি বছর। বছর বছর বিনোদন জগতে যেমন নতুনদের আগমন ঘটে তেমনি অনেক গুণীজন চিরদিনের জন্য বিদায়ও নেন। যারা দেশের শিল্প ও সংস্কৃতির উন্নয়নে অনেক অবদান রেখেছেন কিন্তু ভাগ্যর দোষে আবার আমাদের হারাতে হয়েছে। ২০১৬ সালে সাংস্কৃতি অঙ্গনে বাংলাদেশ অনেক গুণী জনদের হারিয়েছে। চলুন এক নজরে সেই  বিদায়ী শিল্পীদের তালিকা ও তাঁদের সম্পর্কে কিছু জেনে নেওয়া যাক-

দেবনাথ মজুমদার (লালু)

বিশিষ্ট চিত্রসম্পাদক দেবনাথ মজুমদার (লালু)। ‘রুপবানের রুপকথা’ শিরোনামের সিনেমার মাধ্যমে প্রথম চলচ্চিত্র সম্পাদনা করেন। চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি রাত ১০ টায় এ পরলোক গমন করেন তিনি। তার জন্ম ১৯৪৫ সালের ১০ অক্টোবর কুষ্টিয়ায়। তিনি চিত্রনায়িকা সুজাতার (তন্দ্রা মজুমদার) বড় ভাই।

কে এম আর মঞ্জুর

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক কে এম আর মঞ্জুর। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়ার পথে রাত ৩টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির সাবেক এ সভাপতি। তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধ ও জীবনধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণে বিনিয়োগের জন্য একাধিকবার এই পুরস্কার লাভ করেন তিনি। তার প্রোডাকশন হাউজ থেকে নির্মিত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র হলো- দাঙ্গা, সিপাহি, আমার প্রেম আমার অহংকার প্রভৃতি। বাংলাদেশ ফিল্ম ক্লাবের তিনবারের সফল সভাপতি ছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রের ক্রান্তিলগ্নে বিনিয়োগসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বিভিন্ন সংগঠন থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন। একজন সফল প্রদর্শক হিসেবে তার বেশ সুনাম ছিল।

এম এ জলিল

চলতি বছর খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার এম. এ. জলিল ইন্তেকাল করেন। মেঘনা অয়েল কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক এম.এ. জলিল রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩ ফেব্রয়ারি রাত ৩টায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। ১৯৪০ সালের ৮ মে তিনি বাহরাইনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মরহুম বিচারপতি আব্দুল হাফিজের ছেলে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেন। পীচ ঢালা পথ, ময়নামতিসহ বহু সিনেমার নায়ক এম.এ. জলিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটক (ধারাবাহিক) ‘ত্রিরত্নে’ অভিনয় করে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন।

রবিন ঘোষ

তোমারে লেগেছে এত যে ভালো, ফুলের কানে ভ্রমর এসে, পিচঢালা এই পথটারেসহ অসংখ্য গানের সুরকার রবিন ঘোষ। চলতি বছর না ফেরার দেশে চলে যান আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই সংগীত পরিচালক। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৮টায় রাজধানীর গুলশানের কিউর মেডিকেল সেন্টারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। দীর্ঘদিন ধরে ব্রঙ্কাইটিস ও হৃদরোগে ভুগছিলেন রবিন ঘোষ।

চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশামের অনুরোধে তার চলচ্চিত্রের গানে সুর করেন রবিন। ৬০ এর দশকে রাজধানীর বুকে চলচ্চিত্রের গানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক তাঁর। তারপর অনেক বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রের গানে সুর দিয়েছেন এ সংগীতপাগল মানুষটি। তালাশ (১৯৬৩), চকোরি (১৯৬৭), চাহাত (১৯৭৪), আয়না (১৯৭৭), আম্বার (১৯৭৮) ও দরিয়ান (১৯৮৪) চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে নিগার পুরস্কার লাভ করেন রবিন ঘোষ।

খোন্দকার নূরুল আলম

চোখ যে মনের কথা বলে, এতো সুখ সইবো কেমন করে, তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে, আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে, কাঠ পুড়লে কয়লা হয়, এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে এমন অসংখ্য কালজয়ী সুর তৈরি করেছেন সুরকার খোন্দকার নূরুল আলম। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। খোন্দকার নূরুল আলম একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। একুশে পদকও পেয়েছেন তিনি। মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত এই সুরের জাদুকর।

চিত্রনায়িকা দিতি

চিত্রনায়িকা পারভীন সুলতানা দিতি। গত ২০ মার্চ গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মস্তিষ্কে ক্যান্সার ধরা পড়লে ২০১৫ সালের ২৯ জুলাই ভারতের মাদ্রাজের এমআইওটি হাসপাতালে দিতির মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ২০ সেপ্টেম্বর তিনি দেশে ফিরে আসেন। চেন্নাইয়ের হাসপাতালে দিতির মস্তিষ্কে দ্বিতীয়বারের মতো অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপর তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। পরে ৮ জানুয়ারি অসুস্থতা নিয়েই দেশে ফেরেন অভিনেত্রী দিতি। একইদিন সরাসরি ভর্তি করানো হয় রাজধানী গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে। অবশেষে সবাইকে কাঁদিয়ে ২০ মার্চ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি।

শহিদুল ইসলাম খোকন

ঢাকাই চলচ্চিত্রের বরেণ্য নির্মাতা শহিদুল ইসলাম খোকন। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে মুখগহ্বরের ‘মটর নিউরো ডিজিস’(এএলএস)-এ আক্রান্ত ছিলেন খোকন। গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য আমেরিকা গিয়েছিলেন তিনি। অক্টোবরের শেষের দিকে তিনি দেশে ফিরেন। এরপর উত্তরার আধুনিক হাসপাতালে বেশ কিছুদিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।

১৯৭৪ সালে মাসুদ পারভেজ পরিচালিত ‘দস্যু বনহুর’ সিনেমায় সহকারি পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন শহীদুল ইসলাম খোকন। ১৯৮৫ সালে ‘রক্তের বন্দি’ সিনেমার মাধ্যমে মূল পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রায় ৪০টি সিনেমা পরিচালনা করেছেন তিনি। শহিদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত উল্লেখ্যযোগ্য চলচ্চিত্র হলো— ‘ঘাতক’, ‘পালাবি কোথায়’, ‘লাল সবুজ’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘ভণ্ড’ ইত্যাদি। তার প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘রক্তের বন্দি’।

জেড এম এ মবিন

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এবং সীমানা পেরিয়ে ও সূর্যকন্যার মতো কালজয়ী চলচ্চিত্রের বরেণ্য চিত্রগ্রাহক জেড এম এ মবিন চলতি বছর না ফেরার দেশে চলে যান। স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তিনি মিরপুরের একটি হাসপাতালে আইসিইউতে ছিলেন। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ২৫ জুলাই দুপুর ১টার দিকে স্ত্রী আর তিন কন্যাকে রেখে চলে যান তিনি।

একাত্তরের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ ধারণ করেছিলেন এম এ মবিন। চিত্রগ্রাহক ছিলেন সীমানা পেরিয়ে, সূর্যকন্যা, ধীরে বহে মেঘনা, দেবদাস, রাজলক্ষী-শ্রীকান্ত, দীপু নাম্বার টুসহ অনেক প্রশংসিত চলচ্চিত্রের। খ্যাতিমান এই চিত্রগ্রাহক ‘দুখাই’ ও ‘সীমানা পেরিয়ে’ চলচ্চিত্রের জন্য দুইবার অর্জন করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে কর্মজীবনের পাশাপাশি চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন ৩০টি চলচ্চিত্রে।

ফরিদ আলী

বিটিভির প্রথম নাটক ‘একতলা দোতলার’ অভিনেতা ও চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতা ফরিদ আলী। চলতি বছরের ২২ আগস্ট রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কৌতুক অভিনয়ে তিনি দর্শকমনে দাগ কাটতে সক্ষম হন। বিশেষ করে ‘টাকা দেন দুবাই যাব, বাংলাদেশে থাকব না’ এই সংলাপটির সঙ্গে যারা পরিচিত তারা এক বাক্যেই উচ্চারণ করবেন অভিনেতা ফরিদ আলীর নাম। শুধু অভিনয় নয়, নাটক লেখা ও নির্দেশনায়ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন এই শিল্পী।

যোশেফ শতাব্দী  

অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার ও কাহিনিকার যোশেফ শতাব্দী। চলতি বছরের ৭ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ৩টা ২০ মিনিটে সিরাজগঞ্জে নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সিরাগঞ্জের রহমতগঞ্জে পারিবারিক কবরস্থানে যোশেফের মরদেহ দাফন করা হয়। দীর্ঘ দেড় বছর এই কাহিনিকার ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। প্রথমে টিউমার, এরপর ক্যান্সার ধরা পড়ে তার শরীরে। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে খাজা ইউনুস হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

যোশেফের চিত্রনাট্যে নির্মিত উল্লেখযোগ্য সিনেমা হলো দাদি মা, চাচ্চু, মায়ের হাতে বেহেস্তের চাবি, পিতার আসন, ধর্ম আমার মা, আসমান জমিন, কুরবানি, মাটির দুর্গ, সুজন বন্ধু, আসামী হাজির প্রভৃতি।

মোহাম্মদ ফারুক

বাংলাদেশের নাটক ও চলচ্চিত্র জগতের গুণী রূপসজ্জাশিল্পী মোহাম্মদ ফারুক এ বছরের ২ অক্টোবর মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৬৫ সালে রূপসজ্জাশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন মোহাম্মদ ফারুক। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অসংখ্য নাটক ও চলচ্চিত্রের রূপসজ্জাশিল্পী হিসেবে কাজ করেন।

গোলাম হাবিবুর রহমান মধু

চলতি বছর না ফেরার দেশে চলে গেছেন অভিনেতা গোলাম হাবিবুর রহমান মধু। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২৩ নভেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গোলাম হাবিবুর রহমান মধুর জন্ম রাজশাহীতে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে মঞ্চে তার অভিনয়ের হাতিখড়ি। ১৯৬২ সালে বেতারে এবং ১৯৬৯ সালে তিনি টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করেন। তারপর অনেক জনপ্রিয় নাটক দর্শকদের উপহার দিয়েছেন তিনি। অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রেও।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত