বাংলা চলচ্চিত্র: প্রয়োজন পুনরুজ্জীবন

প্রকাশ : ০৫ মে ২০১৬, ২১:০২

বাংলা চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থার কথা প্রায় সকলেরই জানা। পাঠকের কাছে প্রশ্ন রাখলে প্রায় ৯০ শতাংশ উত্তর আসবে ‘‘ভালো না”। কিন্তু বাকি ১০ শতাংশের মধ্যেও বোদ্ধা শ্রেণি থেকে উত্তর আসবে ‘‘ভালো অথবা পূর্বের থেকে ভালো”। সত্যি কি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে? একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, বছরে হাতে গোনা দুই একটি সিনেমা বাদে বাকি সবই ‘‘নতুন মোড়কে পুরোনো মদ” এর মতো। একই মুখ, একই গল্প, একই রুপ শুধু রংটা একটু ভিন্ন। বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়ন বলতে শুধু এনালগ থেকে ডিজিটালে রুপান্তরটুকুই উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বাকি সবই এক।

বাংলা চলচ্চিত্রের ভোক্তা শ্রেণির প্রধান অংশই খেটে খাওয়া শ্রেণি ও পেশার মানুষ। মধ্যম ও উচ্চ শ্রেণির ভোক্তার সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সেই অনেক আগেই। কিন্তু তাদের সিনেমা দেখা কিন্তু থেমে নেই। শুধু সিনেমা হলের পরিবর্তে স্থান পেয়েছে ঘরের টেলিভিশন বা কম্পিউটার। বাংলা সিনেমার বাজার বলতে একমাত্র দেশের পেক্ষাগৃহ ব্যতিত অন্য কোন মাধ্যম তৈরি করতে পারেননি কলাকুশলিরা। তার উপরে মধ্যম ও উচ্চ শ্রেণির সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া বাংলা চলচ্চিত্র ধ্বংসের অন্যতম কারন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। উন্নয়ন প্রত্যাশিরা দর্শকদেরকে সিনেমা হলে ফেরানোর মত চলচ্চিত্র ও পরিবেশ তৈরি করার কথা বললেও সে আশা প্রত্যাশার গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছেন নির্মাতারাই। বছর পাচেক আগে যখন বাংলা চলচ্চিত্র এনালগ থেকে ডিজিটালে রুপান্তর হতে শুরু করলো ঠিক তখন মুখ ফিরিয়ে রাখা দর্শকরা সিনেমা হলে ফিরে যেতে শুরু করলেও তাদেরকে ধরে রাখার কোন ব্যবস্থাই করা হয়নি। বরং ডিজিটাল চলচ্চিত্রের নামে তৈরি সিনেমাগুলোর মাধ্যমে দর্শক শ্রেণির সাথে শুরু হলো বড় ধরণের প্রতারণা। দর্শক গাটের পয়সা খরচ করে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে নতুন কিছু দেখার প্রত্যেশা নিয়ে হলে ঢুকেই দেখছে হুবহু কপি বা আংশিক কপি সিনেমা কিংবা তথাকথিত ভিন্ন ধারার সিনেমার নামে ২/৩ ঘন্টা দৈর্ঘ্যের টেলিভিশন নাটক। অবশ্যই সিনেমা হলে টাকা খরচ করে কেউ নকল সিনেমা বা টেলিভিশন নাটক দেখবে না। এ ব্যপারটি চলচ্চিত্রের কলাকুশলিরা কেন যেন বুঝতে চান না। কোন এক অজানা কারণেই একের পর এক নকল ছবি নির্মাণ করছেন তারা। তারা যেন ভালো মৌলিক চলচ্চিত্র নয় নকল করার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। বছরের পুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর উপর চোখ রাখলে দেখা যায় ১০০টি সিনেমার প্রায় ৯৫টি সিনেমাই নকল।

সম্প্রতি মুরাদ পারভেজের সরকারি অনুদানে নির্মিত ‘বৃহন্নলা’ সিনেমার গল্পটি ভারতীয় লেখকের গল্প থেকে চুরি করা হলেও সেই সিনেমা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে, যদিও পরবর্তীতে প্রতিবাদের মুখে সেই সিনেমার পুরস্কার বাতিল হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার আসলে কাদেরকে অনুদান দিচ্ছে? মুরাদ পারভেজের মতো পরিচালকদেরকে অনুদান দেয়া মানে চুরিকে উৎসাহিত করা। আর যারা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটিতে আছেন তাদের চলচ্চিত্র জ্ঞান ও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এইসব চলচ্চিত্রকে পুরস্কৃত করায়। কোনটা আংশিক আবার কোনটার পুরো কাহিনি অন্য কোন দেশি বা বিদেশি সিনেমা থেকে মেরে দেওয়া হয়েছে। আর বাকি যে ৫ শতাংশ সিনেমা অবশিষ্ট থাকে তার বেশিরভাগই বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। বাংলা চলচ্চিত্রের এমন দুর্দশায় সরকারের কোন পদক্ষেপই নেই। বেশ কয়েক বছর হয়েছে চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করা হয়েছে। শিল্প ইন্ডাস্ট্রি হবার ফলে যেই সকল সুযোগ সুবিধা পাবার কথা তার কিছুই পাওয়া যায়নি। শিল্প শুধু কাগজেই লেখা আছে। বাস্তবতায় সিনেমার আসেনি কোন গুণ বা মানগত পরিবর্তন। এ অবস্থা দেখে যে কেউ বলবে, দেশে চলচ্চিত্র শিল্প বলতে যে কোন একটা শিল্প রয়েছে তা হয়তো সরকারেরই জানা নেই। অবশ্য বছরে দু-চারটি সরকারি অনুদানে ছবি মুক্তি পায় কিন্তু তার কোনটাই ব্যবসা সফল হয়না। কারণ সরকারি অনুদান কোন পেশাদার বা যোগ্য নির্মাতারা পান না বরং ঘুষ বা তোষামোদের মাধ্যমে অথবা সরকারি মন্ত্রী-আমলাদের অযোগ্য আত্মীয় স্বজনেরা পান।

পনেরো-বিশ বছর আগেও ১০ কোটি টাকা লগ্নি করে তা ফেরত আনতে পারতেন প্রযোজকরা। এখন বাংলা সিনেমার গড় বাজেট দাড়িয়েছে ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা বা তারও কম। এর কারণ জানতে চাইলেই প্রযোজক ও হল মালিকদের মধ্যে শুরু হয় কাদা ছোড়াছুড়ি। প্রযোজকরা বলেন হলের পরিবেশ ভালো না তাই দর্শক কমে যাচ্ছে আর হল মালিকরা বলেন সিনেমার মান ভালো না তাই দর্শক আসছেনা, একের পর এক হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ক’বছর আগেও দেশে ১ হাজার ২’শটি সিনেমা হল ছিলো। তার মধ্যে এখন রয়েছে ৩২০টিরও কম। কোন কোন জেলা শহরে এখন আর সিনেমা হলই নেই। আবার যে শহওে ৫ টি ছিলো সেখানে রয়েছে মাত্র একটি। বাংলা চলচ্চিত্রের এই দুরাবস্থায় সরকার এবং কলাকুশলিরা যৌথভাবে দায়ী হলেও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কেউই এই দায় নিতে চান না। তারা উল্টো আঙ্গুল তোলেন সরকারের দিকে।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র মূলত কোমাতে আছে। কিন্তু সবাই আশা করছে এই ইন্ডাস্ট্রি ভালো করবে। কিন্তু কিভাবে এর অগ্রগতি হবে তা নিয়ে কেউ ভাবছে না। দেশের শক্তিশালী এ শিল্পমাধ্যমের জন্য সরকারের তেমন কোন পদক্ষেপই নেই। দেশে কোন পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম ইন্সটিটিউট নেই যেখান থেকে শিল্পী, কলাকুশলিরা আধুনিক জ্ঞান অর্জন করে দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখবে। আধুনিক মানের কোন ফিল্ম সিটি নির্মাণেরও কোন উদ্যোগ নেই।

সুতরাং, সরকার যতদিন এই চলচ্চিত্র শিল্পকে আধুনিক করার জন্য কাজ না করবে ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অবস্থা ভালো হবে না। সরকারের মাথায় রাথা উচিত, চলচ্চিত্র শুধু আর্ট নয় শিল্প ইন্ডাস্ট্রিও। তাই বিশ্বেও সাথে তাল মিলিয়ে চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিতে হবে। তাই এই শিল্পের পুনরুজ্জীবন অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। যদি সরকার আন্তরিকভাবে এ শিল্পের পুনরুজ্জীবন চান তাহলে ক্রিকেট, ফুটবল ও গার্মেন্টস খাতের মত এ খাতেও প্রণোদনা প্রয়োজন। তা না হলে বিদেশি সংস্কৃতির চাপে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ধ্বংস অনিবার্য।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত