কন্সটান্টিনোপলের ইস্তাম্বুল হবার ইতিহাস

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:৪৭

ইস্তানবুল (তুর্কি ভাষায় İstanbul ইস্তান্বুল) তুরস্কের অন্যতম প্রধান শহর। এর পুরোনো নাম কন্সটান্টিনোপল। এছাড়া এটি বাইজান্টিয়াম নামেও পরিচিত ছিল। এটি পূর্বে উসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। ১৪৫৩ সালে এটি তৎকালীন উসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হয়। এটি তুরস্কের সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির কেন্দ্রস্থল। ১৯২৩ সাল পর্যন্ত এখানেই ছিল তুরস্কের রাজধানী। এটি তুরস্কের বৃহত্তম শহর যার জনসংখ্যা ১২.৮ মিলিয়ন। ইস্তানবুলের আয়তন ৫.৩৪৩ বর্গ কিলোমিটার (২,০৬৩বর্গ মাইল)। ইস্তানবুল একটি আন্তর্মহাদেশীয় শহর, এর এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা এশিয়ায় বসবাস করলেও এইটি ইউরোপর বাণিজ্যিক এবং ঐতিহাসিক কেন্দ্র। ইস্তাম্বুল শুধু শহরই নয়, বরং বলা চলে একটি কিংবদন্তী। এক সময় এই ইস্তাম্বুল শহরই ছিল তুরস্কের রাজধানী। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে শত্রু কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে যায় আংকারায়। তাই বলে প্রাচীন রাজধানী ইস্তাম্বুলের গুরুত্ব কোনো অংশেই উপেক্ষা করা যায় না। 

একদা এই ইস্তাম্বুলই ছিল পৃথিবী শাসনকারী বাইজ্যানটাইন ও পরবর্তীতে অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী। ইস্তাম্বুলে রয়েছে প্রভাবশালী সাহাবা আবু আইয়ুব আনসারী ও আরও অনেক সাহাবার পবিত্র সমাধি এবং ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের মূল উপাসনালয় হাজিয়া সোফিয়া। সৌন্দর্যে অনন্য হাজিয়া সোফিয়া শুধু উপাসনালয়ই নয়, বরং তা বাইজ্যানটাইন সাম্রাজ্যের স্থাপত্য নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইস্তাম্বুলের বুকে। আজকেও স্থাপত্যশৈলীর ইতিহাসে প্রথমসারির স্থান দখল করে থাকে ইস্তাম্বুলের পুরাকীর্তি হাজিয়া সোফিয়া। শুধু তুরস্কের নয়, এশিয়া মহাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় শহর হচ্ছে ইস্তাম্বুল। আর ইস্তাম্বুলের প্রধান আকর্ষণ বসফোরাস। কেননা, বসফোরাস প্রণালিতে কলকল বয়ে চলা পানির ধারাটি সংযুক্ত করেছে এশিয়া ও ইউরোপকে। 

এশিয়া ও ইউরোপকে একত্রে বলা হয় ইউরেশিয়া, যার বিভাজন রেখা হলো বসফোরাস প্রণালি, যে প্রণালির অবস্থান ইস্তাম্বুলে। এ কারণে ইস্তাম্বুলকে বলা হয়, দুটি মহাদেশের একটি শহর। অত্যন্ত সুচারু ও পরিকল্পিত শহর ইস্তাম্বুল। নিত্য দিনের সূর্য্যরে আলোয় ঝিকমিক করে শহরটি। দেখে যেন মনে হয় স্বপ্নের জগ্রত। শহরটির দু-ধারে সাজানো-গোছানো পরিকল্পিত বাড়িঘর, দালান-কোঠা, মাঝে মাঝে বৃক্ষরাজির অপরূপ শোভা, মাঝখানে বসফোরাস প্রণালি। এ যেন শিল্পীর তুলিতে অঙ্কিত কোনো চিত্রশিল্প। ইস্তাম্বুলের ভেতর দিয়ে যে বসফোরাস প্রণালি বয়ে গেছে এর আয়তন ৩২ কিলোমিটার। উত্তরে কৃষ্ণসাগর এবং দক্ষিণে মর্মর সাগর। প্রণালির গভীরতা গড়ে ৫০ মিটারের মতো। প্রশস্ততা কোথাও কম, আবার কোথাও বেশি। ইউরোপ ও ভলকান রাষ্ট্রগুলোর জাহাজ চলে এই প্রণালি দিয়ে। ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ডবাজার এশিয়ার একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিশাল বাজার। 

এখানে প্রাচীন ঐতিহ্য ও আধুনিক রুচির এক অপরূপ সমন্বয় ঘটেছে। আরবী জীবনধারার সাথে এশীয় জীবন-প্রবাহের এক প্রাণবন্ত মিশ্রণ। মুসলিম সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সেতুবন্ধন এখানে স্পষ্ট অনুভব করা যায়। ছোট ছোট দোকানগুলো পণ্য দ্রব্যে ভরপুর। কী নেই এখানে? সোনা-দানা, মণি-মুক্তা থেকে শুরু করে জামা-কাপড়-কার্পেট, চামড়াজাতীয় জিনিস, হাতের চুড়ি, খোপার কাঁটা সবকিছুই রয়েছে এখানে। এছাড়াও ঐতিহাসিক হিপোড্রোম বা সুলতান আহমদ স্কয়ার ইস্তাম্বুলের এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য।

অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম শাসক দ্বিতীয় মুহাম্মদ বীরত্বে একসময়ের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনাপল অটোমান সাম্রাজ্যের অধিকারে আসে। তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিপোল বিজয়ের কারণে। মারমারা সমুদ্র এবং গোল্ডেন হর্ণ এর সঙ্গমস্থলে কনস্টান্টিপোলের অবস্থান হবার কারণে কনস্টান্টিপোল দখল অনেকটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। কিন্তু সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের মনোবল ও বুদ্ধিমত্তা তাকে সেই দু:সাধ্যতা অতিক্রম করতে সহায়তা করে। ছোটবেলা থেকেই দ্বিতীয় মোহাম্মদ অসীম সাহসী ও বুদ্ধিমান হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে বসফরাসের পূর্বপ্রান্তে বসে মোহাম্মদ প্রায়শই চিন্তামগ্ন হতেন কি করে কনস্টান্টিপোল জয় করা যায়। তাঁর সাহস ও তাঁর ধীশক্তি অবশেষে তার উদ্ভাবনী শক্তি যোগায়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে সম্মুখের নৌযুদ্ধ পরিহার করে কনস্টান্টিপোলের পূর্ব ও উত্তর প্রান্তের পশ্চাৎদিক দিয়ে তিনি কনস্টান্টিপোল আক্রমন করবেন। 

কনস্টান্টিনোপল বিজয় ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ কর্তৃক শহরটি অধিকারের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। পূর্বে এটি পূর্ব রোমান (বাইজেন্টাইন) সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। শহর অধিকারের পূর্বে এটি জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৬ এপ্রিল থেকে ২৯ মে পর্যন্ত অবরোধের সম্মুখীন হয়। এরপর চূড়ান্তভাবে শহরটি অটোমানদের অধিকারে আসে। কনস্টান্টিনোপলে বিজয়কে ১৫০০ বছরের মত টিকে থাকা রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অটোমানদের এই বিজয়ের ফলে অটোমান সেনাদের সামনে ইউরোপে অগ্রসর হওয়ার পথে আর কোনো বাধা থাকল না। খ্রিস্টানজগতে এই পতন ছিল বিরাট ধাক্কার মত। বিজয়ের পর সুলতান মুহাম্মদ তার রাজধানী এড্রিনোপল থেকে সরিয়ে কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে আসেন। শহর অবরোধের আগে ও পরে শহরের বেশ কিছু গ্রীক ও অগ্রীক বুদ্ধিজীবী পালিয়ে যায়। তাদের অধিকাংশ ইতালিতে চলে যায় এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁতে সাহায্য করে। বেশ কিছু ইতিহাসবিদ কনস্টান্টিনোপলের বিজয় ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনকে মধ্য যুগের সমাপ্তি হিসেবে দেখেন। 

অটোমানদের জন্য বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল জয় করা সহজ ছিল না। কনস্টান্টিনোপলের শহরে প্রায় ২০ কিমি দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। এটি ছিল সেসময়ের অন্যতম মজবুত দেয়াল। কিছুকাল পূর্বেই বাইজেন্টাইন সম্রাট অষ্টম জন পেলেইওলোগস এটির সংস্কার করেছিলেন। দেয়ালের অবস্থা যথেষ্ট ভাল ছিল। ফলে বাইজেন্টাইনদের ধারণা ছিল পশ্চিমা সাহায্য আসার আগ পর্যন্ত তারা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে। তার উপর বাইজেন্টাইন প্রতিরক্ষাকারীরা ২৬ টি জাহাজের একটি নৌবহর দ্বারা শক্তি প্রাপ্ত ছিল। এর মধ্যে ৫টি জেনোয়া, ৫টি ভেনিস, ৩টি ভেনিসিয়ান ক্রিট, ১টি আনকোনা, ১টি আরাগন, ১টি ফ্রান্স থেকে ও প্রায় ১০টি বাইজেন্টাইনদের জাহাজ ছিল। ৫ এপ্রিল সুলতান তার এক শক্তিশালী সেনাদল নিয়ে দূর্গের কাছে পৌছলে বাইজেন্টাইনরা তাদের অবস্থান গ্রহণ করে। সৈন্য সংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে দেয়ালের সব অংশে অবস্থান নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না বিধায় সিদ্ধান্ত হয় যে শুধু বাইরের দেয়ালে সেনা মোতায়েন করা হবে। কনস্টান্টাইন ও তার গ্রিক সেনারা দেয়ালের মাঝের অংশ রক্ষায় অবস্থান নেয়। দেয়ালের এই অংশটিকে সবচেয়ে দুর্বল অংশ হিসেবে দেখা হত এবং এই দিক থেকে আক্রমণের আশঙ্কাও বেশি ছিল। জিসটিনিয়ানি সম্রাটের নির্দেশে দূর্গের উত্তর দিকে অবস্থান নেন। পরবর্তীতে অবরোধ চলার সময় তিনি সম্রাটের অবস্থানের জায়গায় চলে আসেন। তার পূর্বের অবস্থানে বোকিয়ারডি ভাইদের দায়িত্ব দেয়া হয়।

মিনট্টো ও তার ভেনিসিয়ানরা ব্লেচারনে প্রাসাদে টিউডোরো কেরিসটো, লেনগেসকো ভ্রাতৃবৃন্দ ও আর্চবিশপ লিউনার্দো অব চিওস এর সাথে অবস্থান নেন। সম্রাটের বাম পাশে কিছুটা দক্ষিণে সেনানায়ক কাটানিও ও জেনোয়ার সৈনিকেরা এবং গ্রীক সৈনিকদের সাথে অবস্থানরত থিওফিলিস পেলেইওলোগস অবস্থান করছিলেন। দেয়ালের একটি অংশে ভেনিসিয়ান ব্যক্তি ফিলিপ্পো কনটারিনি এবং সর্বদক্ষিণে ডিমিটরিয়াস কেন্টাকুজেনাস অবস্থান নেন। সমুদ্রের দেয়ালে অপেক্ষাকৃত কম সৈনিক মোতায়ন করা হয়। স্টেডিয়ানে জেকোবো কনটারিনি, তার বাম পাশে গ্রীক পুরোহিতদের একটি দল এবং এলিউথেরিয়াস পোতাশ্রয়ে যুবরাজ ওরহানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। জেনোয়াস ও কাটালান সৈনিকদের সাথে পিরে জুলিয়া প্রাসাদে অবস্থান নেন। কিয়েভের কার্ডিনাল ইসিডর উপদ্বীপের প্রান্তে অবস্থান নেন। দক্ষিণ উপকূলের সমুদ্র দেয়ালগুলোতে গেবিয়েল ট্রেভিসানোর অধীন ভেনিসিয়ান ও জেনোয়ার নাবিকরা পাহারার দায়িত্ব পালন করে। কৌশলগত কারণে শহরের ভেতর দুইটি রিজার্ভ বাহিনী রাখা হয়। এর একটি হল লুকাস নটরাসের অধীনে পেট্রায় ও অন্যটি নিসেফোরোস পেলেইওলোগসের অধীনে চার্চ অব দ্য হলি এপস্টলসের কাছে। ভেনিসিয়ান কমান্ডার আল্ভিসো ডিয়ডো পোতাশ্রয়ের জাহাজগুলোকে নেতৃত্ব দেন। বাইজেন্টাইনদের কামান থাকলেও সেগুলো অটোমানদের তুলনায় ছোট ছিল এবং গোলা ছোড়ার পর কামানের পেছনদিকের ধাক্কার ফলে তাদের নিজেদের দেয়ালেরই ক্ষতি হচ্ছিল। ডেভিড নিকোলের মতে (২০০০ খ্রিষ্টাব্দ), কনস্টান্টিনোপল খুব সহজেই বিজয় হয় একথাটা সঠিক নয়। মানচিত্রে দেখানোর মত পুরো ব্যাপারটি একপক্ষীয় ছিল না। এমনও দাবি করা হয় যে কনস্টান্টিনোপল ঐ সময় ইউরোপের সবচেয়ে মজবুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শহর ছিল। মূলত অটোমান সৈন্যদের বীরত্ব ও দ্বিতীয় মুহাম্মদের রণ কৌশলের কাছেই কনস্টান্টিনোপলের পতন হয়।

অবরোধের শুরুতে সুলতান মুহাম্মদ শহরের বাইরে বাইজেন্টাইনদের শক্তিকেন্দ্রগুলো ধ্বংস করার জন্য তার সেরা সৈনিকদের একটি দল পাঠান। কয়েকদিনের মধ্যে বসফরাসের কাছে থেরাপিয়া দুর্গ ও স্টুডিয়াস গ্রামে মারমারা সাগরের নিকটে অনুরূপ আরেকটি দুর্গ অটোমানরা দখল করা নেয়। মারমারা সাগরে প্রিন্সেস দ্বীপপুঞ্জে এডমিরাল বালতুঘলুর বাইজেন্টাইন নৌবহর দখল করে নেয় এবং কয়েক সপ্তাহ ধরে নৌবাহিনীর কামানগুলো শহরের দেয়ালের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে হামলা করতে না পারা এবং হামলার গতি তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় বাইজেন্টাইনরা ক্ষতিগ্রস্থ অংশ দ্রুত মেরামত করতে সক্ষম হয়। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার চেষ্টার পরও বালতুঘলুর অধীন অটোমান নৌবহরগুলো গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করতে পারেনি। বাইজেন্টাইনরা এর প্রবেশমুখে প্রতিরক্ষামূলক ধাতব শিকল বসিয়ে দেয় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। বাইরের কোনো জাহাজকে গোল্ডেন হর্নে প্রবেশে বাধা দেয়া তুর্কি নৌবহরের প্রধান কাজ হলেও ২০ এপ্রিল চারটি বাইজেন্টাইন জাহাজের একটি ক্ষুদ্র দল বেশ বড় লড়াইয়ের পর এতে ঢুকে পড়ে। এতে বাইজেন্টাইনদের মনোবল বেড়ে যায় এবং সুলতান মুহাম্মদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাড়ায়। বালতুঘলুর অধীনস্থ সৈনিকেরা লড়াইয়ের সময় তার সাহসিকতার ব্যাপারে নিশ্চিত করায় ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাকে সুলতান মুহাম্মদ তাকে ক্ষমা করে দেন।

এরপর সুলতান মুহাম্মদ অন্য পথ অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি গোল্ডেন হর্নে উত্তরে গালাটার উপর দিয়ে চর্বি মাখানো কাঠের একটি রাস্তা তৈরীর আদেশ দেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে সম্মুখের নৌযুদ্ধ পরিহার করে কনস্টান্টিপোলের পূর্ব ও উত্তর প্রান্তের পশ্চাৎদিক দিয়ে তিনি কনস্টান্টিপোল আক্রমণ করবেন। গল্পের মত শুনালেও সত্যি যে তিনি গরুর মাংশের চর্বির সাহায্যে রাস্তা পিচ্ছিল করে নৌকা পরাপার করে উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্ত থেকে গোল্ডেন হর্নে অবস্থান নিয়ে গোলন্দাজ বহিনী দ্বারা বাইজেন্টাইন সৈন্যদের উপর আক্রমণ করেন। ফলে রসদ সরবরাহ করা জেনোয়ার জাহাজগুলো বাধার মুখে পড়ে এবং বাইজেনটাইনদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। ২৮ এপ্রিল রাতে বাইজেন্টিয়ানরা অটোমান জাহাজগুলো ধ্বংস করার একটা চেষ্টা চালায়। কিন্তু অটোমানরারা পূর্বে এর সংকেত পাওয়ায় উল্টো খ্রিস্টান বাহিনী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং পিছু হটে। এরপর বাইজেন্টাইনরা গোল্ডেন হর্নের অংশে অধিক মাত্রায় সেনা সমাবেশ করে। ফলশ্রুতিতে অন্য অংশের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে। ২৯ এপ্রিল ২৬০ জন অটোমান বন্দীকে অটোমানদের চোখের সামনে দেয়ালের উপর শিরচ্ছেদ করা হয়। ভূমির দেয়ালে বেশ কয়েকবার আক্রমণের পরও তুর্কিরা সফলতা লাভ করেনি। 

ভেনিসিয়ান সার্জন নিকোলো বারবারো (Nicole Barbera) তার ডায়েরিতে জেনিসারি সৈন্যদের আক্রমণের বিষয়ে লেখেন, ‘‘বাইজেন্টাইনরা তুর্কিদের দেয়ালের নিচ দিয়ে যুদ্ধের জন্য আসতে দেখল, বিশেষত জেনিসারিদের (তুর্কী সৈন্য) এবং যখন তাদের এক বা দুইজন মারা যায়, আরো তুর্কি যোদ্ধা চলে আসে এবং মৃতদেরকে নিয়ে যায়। তারা দেয়ালের কত নিকটে এসে গিয়েছে সে বিষয়ে ভাবছিল না। আমাদের লোকেরা মৃতদেহ বহনকারী তুর্কিদের দিকে কামান ও ক্রসবোর সাহায্যে আক্রমণ করে এবং তাদের সকলেই মৃতে পরিণত হয়, এরপর আরো একজন তুর্কি তাদেরকে নিতে এগিয়ে আসে, কেউই মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছিল না, তারা স্বেচ্ছায় দশজন মরতে প্রস্তুত ছিল কিন্তু একজন তুর্কির লাশও দেয়ালের কাছে ফেলে রাখতে রাজি ছিল না।”

যুদ্ধক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় অটোমানরা ভূগর্ভস্থ সড়ঙ্গ দিয়ে দেয়ালের বাধা ভাঙ্গার চেষ্টা করে। মে মাসের মধ্যভাগ থেকে ২৫ মে পর্যন্ত খনন কাজ চলে। অধিকাংশ খননকারী ছিল সার্বিয়ান শাসক কর্তৃক প্রেরিত নোভো বরডোর জার্মান বংশোদ্ভূত। তাদেরকে সেনাপতি জাগান পাশার অধীনে দায়িত্ব দেয়া হয়। বাইজেন্টাইনরা জোহাননেস গ্রান্ট (বলা হয় যে তিনি জার্মান ছিলেন, তবে স্কটিশ এর ব্যাপারেও মত আছে) নামক একজন প্রকৌশলীকে নিয়োগ দেয়। তার কাজ ছিল পাল্টা সড়ঙ্গ খুড়ে তুর্কি খননকারীদের হামলা করা। ১৬ মে এর রাতে বাইজেন্টাইনরা প্রথম অটোমানদের সড়ঙ্গ আবিষ্কার করে। পরবর্তী সুড়ঙ্গগুলো ২১, ২৩ ও ২৫ মে রাতে বাইজেন্টাইনরা আবিষ্কার করে এবং সেগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়। ২৩ মে বাইজেন্টাইনরা দুই জন তুর্কি অফিসারকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করে অটোমানদের সকল সুড়ঙ্গের অবস্থান জেনে নেয় ও সেগুলো ধ্বংস করে দেয়।

২১ মে সুলতান মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপলে একজন দূত পাঠান। তিনি ঘোষণা করেন শহর তার কাছে হস্তান্তর করা হলে কনস্টান্টিপোল অবরোধ তুলে নেয়া হবে বলে তিনি প্রস্তাব দেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে সম্রাট ও অন্য যেকোন বাসিন্দাকে তাদের সম্পত্তিসহ চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। তাছাড়া সম্রাটকে পেলোপোননিসের গভর্নর হিসেবে মেনে নেয়ারও প্রস্তাব দেন। সর্বশেষে তিনি শহরে যারা থেকে যাবে তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দেন। কনস্টান্টাইন উচ্চমাত্রায় করপ্রদান ও তুর্কিদের হস্তগত হওয়া দুর্গ ও এলাকাকে অটোমান সম্পত্তি হিসেবে মেনে নিতে সম্মত হন। 

তবে কনস্টান্টিনোপলের রাজা এ ব্যাপারে বলেন, আপনাকে শহর হস্তান্তর করা আমার বা এর অধিবাসীদের উপর নির্ভর করে না; আমরা সবাই স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং আমরা আমাদের জীবনের পরোয়া করবো না। এই সময়ের মধ্যে সুলতান মুহাম্মদ তার উচ্চপদস্থ অফিসারদের সাথে চূড়ান্ত বৈঠক করেন। তবে কিছু দ্বিমত দেখতে পান। তার অন্যতম উজির হালিল পাশা যিনি সবসময় সুলতানের কনস্টান্টিপোল নগর জয়ের পরিকল্পনার বিরোধীতা করতেন, সুলতানকে সতর্ক করে অবরোধ তুলে নিতে বলেন। সুলতান মুহম্মদ হালিল পাশার স্থলে জাগান পাশাকে দায়িত্ব প্রদান করেন। জাগান পাশা অবিলম্বে আক্রমণের পক্ষে ছিলেন। ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে সে বছরে হালিল পাশার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। সুলতান দেয়াল ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন যাতে বাইজেন্টাইনদের প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়া যায়। ২৬ মে সন্ধায় চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু হয় এবং পরদিন পর্যন্ত তা জারি থাকে। যুদ্ধসভার সিদ্ধান্তের ৩৬ ঘন্টা পর অটোমানরা তাদের সৈন্যচালনা শুরু করে। ২৮ মে সৈনিকদের প্রার্থনা ও বিশ্রামের জন্য মঞ্জুর সময় করা হয়। এরপর চড়ান্ত আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। বাইজেন্টাইন অংশে ১২টি জাহাজের ক্ষুদ্র ভেনিসিয়ান নৌবহর এজিয়ান সাগরে তল্লাশির পর রাজধানী পৌছে সম্রাটকে জানায় যে ভেনিসিয়ান রসদের কোনো জাহাজ পথিমধ্যে নেই। ২৮ মে অটোমান সেনারা চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হলে শহরে বড় আকারের ধর্মীয় পদযাত্রার আয়োজন করা হয়। সন্ধায় হাগিয়া সোফিয়াতে বক্তৃতা দেয়া হয় যাতে সম্রাট এবং ল্যাটিন ও গ্রিক উভয় চার্চ অংশ নেয়। ২৯ মে মধ্যরাতের কিছু পরে আক্রমণ শুরু হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের খ্রিস্টান সৈনিকরা প্রথম আক্রমণ করে। এরপর অনিয়মিত আজাপ ও আনাতোলিয়ানরা আক্রমণ করে। শহরের উত্তর অংশের দেয়ালে তারা আক্রমণ করে। এই দেয়ালগুলো কামানের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এগুলো এগারো শতকে নির্মাণ করা হয় বলে এগুলো যথেষ্ট দুর্বল ছিল। জিওভান্নো জিসটিনিয়ানি আক্রমণের সময় মারাত্মক আহত হন। তার এই অবস্থা দেখে বাইজেন্টিয়ান প্রতিরোধকারীদের ভেতর ভীতির সঞ্চার করে। তাকে চিওসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি কয়েকদিন পর মারা যান। জিসটিনিয়ানির অধীন জেনোয়ার সৈনিকরা শহরের ভেতর ও পোতাশ্রয়ের দিকে পিছু হটে। কনস্টান্টাইন ও তার সৈনিকেরা এখন তাদের নিজের প্রতিরক্ষার উপর নির্ভর করতে হয়। তারা জেনিসারিদের কিছু সময় পর্যন্ত প্রতিরোধ করলেও একসময় তারা শহরে ঢুকে পড়ে। যখন একটি ফটকে তুর্কি পতাকা দেখা যায় তখন সৈনিকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয় এবং উলুবাতলি হাসান তার সৈনিকদের নিয়ে এগিয়ে গেলে প্রতিরোধ ভেঙ্গে যায়। 

কথিত আছে যে সম্রাট কনস্টান্টাইন তার বেগুনি রাজপোষাক ছুড়ে ফেলে চূড়ান্ত লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। এই যুদ্ধে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে নিকোলো বারবারো নামক ভেনিসিয়ান প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, তুর্কিরা সান রোমানো ফটক দিয়ে ঢুকে পড়লে কনস্টান্টাইন ফাঁসিতে ঝুলে পড়েন। তবে তার পরিণতি কী হয়েছিল তা অজানা থেকে যায়। ভীতচকিত বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী দূর্গরক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করলেও সাত সপ্তাহ ধরে প্রবল আক্রমণের মুখে দূর্গে ভাঙ্গন দেখা দেয় এবং ১৪৫৩ সালের ২রা মে রাতের শেষদিকে অটোমান বাহিনী দুর্গাভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ভীত রাজধানীবাসী তখন হ্যাগিয়া সোফিয়াতে প্রার্থনারত ছিল বলে ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন (Edward Gibbon) তা উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয় মুহাম্মদ ভোরে হ্যাগিয়া সোফিয়ার দ্বারপ্রান্তে অশ্বপৃষ্ঠে প্রবেশ করেন এবং অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে মাটিতে চুম্বন করেন। তিনি হ্যাগিয়া সোফিয়ার শীর্ষে চাঁদতারা পতাকা উড্ডীন করে তার বিজয় ঘোষণা করেন এবং কনস্টান্টিপোলকে তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করেন। কনস্টান্টিপোল বিজয়ের কাহিনী ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন (Edward Gibbon) যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা অসাধারণ-এটি ঐতিহাসিক বর্ণনা নয়, সাহিত্যিক অনুধাবন। বলা যায় কনস্টান্টিপোল বিজয় এডওয়ার্ড গিবন (Edward Gibbon) এর The decline and fall of the Roman Empire  গ্রন্থের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং রোমানঞ্চকর অধ্যায়। কনস্টান্টিপোল বিজয় শুধু একটি শহরের বিজয় নয়-একটি সভ্যতার বিজয়। এই বিজয়ের বীর তখন আর কেবল গাজি বা দ্বিতীয় সুলতান মুহাম্মদ নন, তিনি ইতিহাসের মুহাম্মদ ফতিহ(বিজয়ী) একটি সম্রজ্যের অধীশ্বর, সম্রাট। 

হামলার পর অটোমান সেনারা শহরের সড়ক, প্রাক্তন ফোরা, এবং চার্চ অব দ্য হলি এপস্টলস এসব এলাকয় চলে আসে। সুলতান মুহাম্মদের ইচ্ছা ছিল যে তার নবনিযুক্ত পেট্রিয়ার্ককে একটি পদ দেয়া যাতে তিনি তার খ্রিস্টন প্রজাদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন। তাই তিনি চার্চ অব দ্য হলি এপস্টলসের মত স্থাপনা রক্ষার জন্য একটি নিরাপত্তা দল পাঠান। জেনিসারী সেনারা হাগিয়া সোফিয়ার সামনের চত্বর অগাস্টিয়ামে চলে আসে। এর ব্রোঞ্জের ফটকের ভেতর বিপুল বেসামরিক লোক স্বর্গীয় নিরাপত্তার আশায় অবস্থান নিয়েছিল। দেয়াল ভেঙ্গে ফেলার পর সৈনিকরা মূল্যবান বস্তুকে অধিকার করা শুরু করে। বিজয়ের তৃতীয় দিন সুলতান মুহাম্মদ সব ধরনের লুটপাট বন্ধের নির্দেশ দেন এবং সৈনিকদের শহরের বাইরে পাঠান। 

ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী বাইজেন্টাইন ইতিহাসবিদ জর্জ স্ফ্রান্টজেজের (George Sphrantzes) বর্ণনা অনুযায়ী “আমাদের শহরের পতনের তৃতীয় দিন সুলতান তার বিজয় উদযাপন করেন। তিনি এই মর্মে আদেশ জারি করেনঃ লুকিয়ে থাকা সকল বয়সের নাগরিকদেরকে মুক্ত মানুষের মত বেরিয়ে আসতে হবে এবং তাদের কোনো প্রশ্ন করা হবে না। তিনি এও ঘোষণা করেন যে অবরোধের আগে যারা শহর ত্যাগ করে চলে গেছে তাদের বাড়ি ও সম্পদ পুনর্বহাল করা হবে, যদি তারা বাড়ি ফিরে আসে তবে তাদের সাথে তাদের পদ ও ধর্ম অনুযায়ী ব্যবহার করা হবে, যেন কিছুই পরিবর্তন হয়নি। হাগিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়। তবে গ্রীক অর্থোডক্স চার্চকে আগের মতই রেখে দেয়া হয় এবং গেনাডিয়াস স্কোলারিয়াসকে কনস্টান্টিনোপলের পেট্রিয়ার্ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়’’।

কনস্টান্টিনোপলের অধিকারের মাধ্যমে সুলতান তার নতুন রাজধানী পেয়ে যান। ইউরোপে অটোমানদের অগ্রসরে এরপর আর কোনো বড় বাধা থাকল না। খ্রিস্টান জগতে এই শহর হাতছাড়া হওয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন তোলে এবং পশ্চিমা খ্রিস্টানদের প্রাচ্যের প্রতি আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সহায়ক হয়। পোপ পঞ্চম নিকোলাস ক্রুসেডের মত আরেকটা আক্রমণের ডাক দেন। যখন কোনো ইউরোপীয় শাসক এতে রাজি হল না, পোপ নিজেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু তার মৃত্যুর ফলে এই পরিকল্পনা সাধিত হয়নি। পন্ডিতরা কনস্টান্টিনোপলের পতনকে মধ্য যুগের সমাপ্তি এবং রেনেসার শুরু হিসেবে দেখেন। এর কারণ হল, এই ঘটনার পর ইউরোপে পুরনো ধর্মীয় রীতির অবসান হয় এবং কামান ও বারুদের ব্যবহার শুরু হয়। উক্ত এলাকায় তুর্কিদের একাধিপত্যের কারণে এটি ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের মূল সংযোগস্থল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইউরোপীয়রা সমুদ্রপথে এশিয়া আসার পথ বের করাকে গুরুত্বের সাথে দেখা শুরু করে। 

কনস্টান্টিনোপলের পতনকে কেন্দ্রকরে গ্রীসে বেশ কিছু কিংবদন্তি রয়েছে। বলা হয় যে ২২ মে ১৪৫৩ এর চন্দ্রগ্রহণ শহরের পতনের পূর্বাভাস ছিল। চারদিন পর পুরো শহর কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এই অঞ্চলে মে মাসে এমনটা আগে কখনও হত না। সেদিন সন্ধ্যায় কুয়াশা মিটে যাওয়ার পর হাগিয়া সোফিয়ার গম্বুজে অদ্ভুত একটা আলো দেখা যায়। কেউ কেউ এটিকে পবিত্র আত্মার শহর ত্যাগ হিসেবে ব্যাখ্যা করে। অন্যরা তখনও আশা ধরে রেখেছিল। তাদের ধারণা ছিল এটি শহর রক্ষার জন্য আসা জন হুনয়াডির বাহিনীর লোকেদের ক্যাম্পফায়ারের আলো। তবে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মতে আলোটি মূলত বিরূপ আবহাওয়ার জন্যই ছিল। 

আরেকটি ভাষ্যমতে প্রথম তুর্কি সৈনিক শহরে প্রবেশের পর দুজন পাদ্রী ধর্মীয় গীতি পড়তে পড়তে ক্যাথেড্রালের দেয়ালে অদৃশ্য হয়ে যান। কিংবদন্তি অনুসারে, কনস্টান্টিনোপল যেদিন আবার খ্রিস্টানদের হাতে আসবে সেদিন তারা ফিরে আসবেন। আরেকটি কিংবদন্তি মতে, যখন অটোমানরা শহরে প্রবেশ করে একজন ফেরেশতা সম্রাটকে উদ্ধার করে এবং তাকে মার্বেলে রূপান্তরিত করে গোল্ডেন গেটের কাছে ভূগর্ভস্থ একটি গুহায় লুকিয়ে রাখে। সেখানে তিনি পুনর্জীবন লাভের জন্য অপেক্ষা করছেন।

কনস্টান্টিপোল বিজয়ের ফলে রাজধানী ব্রুসো (Bruso) ও আড্রিয়ানোপোল (Adrianople) তখন থেকেই কনস্টান্টিপোল (Constantinople) এর নাম হয় ইস্তাম্বুল যা শুধু এশিয়া ও ইউরোপকে ভৌগোলিকভাবে একত্রিত করেনি, দুটি সভ্যতাকে একত্রিত করেছে-একটি ঐতিহ্যবাহী ইসলামী সভ্যতা এবং অপরটি তখনও শত্রুভাবপন্ন বিজিত খ্রিস্টান সভ্যতা। দ্বিতীয় মুহাম্মদ একজন প্রকৃত গাযীর ন্যায় দুটি সভ্যতাকে একত্রিত করে পরবর্তীতে যে অটোমান মিশ্র সভ্যতার বীজ বপন করেছিলেন তা অনেকাংশেই বাইজ্যান্টিয়ান থেকে প্রাপ্ত উত্তারাধিকার সভ্যতা। এতদিন অটোমান সাম্রাজ্যে গ্রিক-রোমান ও বাইজেন্টিয়ান প্রভাব ছিল পরোক্ষ, কনস্টান্টিপোল বিজয়ের ফলে অটোমান সাম্রাজ্যে এর প্রভাব পড়েছিল প্রত্যক্ষ। এশিয়া- বাইজেন্টিয়ান মিশ্রিত সভ্যতা পরবর্তীতে ইউরো-এশিয়ার যে সংযোগ সাধন করে তা বর্তমান কালেও বিশেষভাবে দৃশ্যমান। তুরস্ক মুসলিম রাষ্ট্র হলেও নিকটবর্তী অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র থেকে সংস্কৃতিতে আলাদা। দীর্ঘ ছয়শত বছর ইউরোপীয়করণে অভ্যস্ত এই রাষ্ট্র বর্তমানে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে ইউরোপের সম্পর্কের একটি সেতু বন্ধন।

সরকারি কর্মকর্তা
[email protected]

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত