অযত্নে ১৩ জমিদার বাড়ি

প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো রক্ষার দাবি সচেতন মহলের

প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৩, ১৭:৩৩

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি
ছবি: সাহস

অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার আড়াইশ বছরের পুরোনো ১৩ জমিদার বাড়ি। একদিকে অযত্নে পড়ে থাকা অন্যদিকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যগুলো। ১৩টি জমিদার বাড়ির মধ্যে চারটি বাড়ি বর্তমানে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে আর দুইটি বাড়ি নতুনভাবে সংস্কার করে ব্যবহার করছে স্থানীয়রা। এছাড়া বাকী বাড়িগুলোর অবস্থা একেবারেই জরাজীর্ণ হওয়ায় এগুলো পরিণত হয়েছে মাদকসেবী ও জুয়াড়িদের অভয়াশ্রমে।

সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলুসখা গ্রামটি ছিল জমিদারদের চারণভূমি। একটি গ্রামেই ছিল ১৩ জন জমিদারের বসবাস। এর মধ্যে ১২ জন জমিদার ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং একজন ছিলেন মুসলিম। ১৯৪৭ সনে ভারতবর্ষ দ্বি-খন্ডিত হওয়ার পর অধিকাংশ জমিদারই চলে যান ভারতে। তাদের উত্তরাধিকারীরা ভারতে এবং কেউ কেউ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছেন।

জলসুখা গ্রামের সংরক্ষিত দলিলের তালিকা অনুযায়ী জমিদাররা হলেন, লক্ষ্মীকান্ত রায়, চন্দ্র কুমার রায়, গোবিন্দ চন্দ্র রায়, ক্ষেত্রনাথ রায়, কৃষ্ণ কুমার রায়, ভারত চন্দ্র রায়, সতীশ চন্দ্র রায়, রমা বল্লব হালদার, শরৎ চন্দ্র রায়, নন্দলাল রায়, সতীশ কুমার রায়, মাধব চন্দ্র রায় ও রমজান আলী চৌধুরী ওরফে বুছা মিয়া চৌধুরী। তারা একেকজন ছিলেন একেক তাল্লুক বা চৌহুদ্দার খাজনা আদায়ের দায়িত্বে।

স্থানীয় সাংবাদিক ফরহাদ চৌধুরী জানান, জমিদার সতীশ কুমার রায় ছিলেন অখন্ড ভারতবর্ষের শিক্ষাবোর্ডের ডাইরেক্টর। তার ভাই মাধব চন্দ্র রায় ছিলেন আরসিসি’র জনক। এছাড়া জমিদার প্রতাপ সিংহ রায়ের ছেলে সতীশ চন্দ্র রায় ছিলেন অখন্ড ভারতবর্ষের একজন খনিজ বিদ্যা বিশারদ। প্রাচীন তথ্য বলছে অধিকাংশ জমিদাররাই ছিলেন শিক্ষানুরাগী। এর মধ্যে জমিদার চন্দ্র কুমার রায় ১৮৭৬ সনে “কৃষ্ণ গোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়” নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও প্রতিষ্ঠা করেন। 

স্থানীয়রা জানান, ১৩ জমিদারের মধ্যে চন্দ্র কুমার রায় ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারী মনোভাবের। তার মহলের সামনে দিয়ে কেউ জুতা পরে যেতে পারতেন না। জুতা পরে গেলেই তাকে ধরে এনে করা হতো অত্যাচার। দেয়া হতো শাস্তি।

সরেজমিনে জলসুখা গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় দেখা যায়, জরাজীর্ণ একটি ভবন। তার নাম ছিল আটচালা। স্থানীয়দের বিবরণ অনুযায়ী এ ভবনটির মালিক ছিলেন জমিদার গোবিন চন্দ্র রায়। ১৩ জমিদারের সবার চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী ছিলেন তিনি। আটচালা ভবনটিতে বৈঠক করতেন ১৩ জমিদার। ভবনটি বর্তমানে একেবারেই অরক্ষিত। সন্ধ্যার পরপরই সেখানে জুয়াড় আসর বসে বলে জানান স্থানীয়রা। তবে বর্তমানে এ বাড়িটির একটি কক্ষে সরকারি ভূমি অফিস।

কথা হয় জরাজীর্ণ একটি মহলে থাকা জমিদার পরিবারের এক বংশধর কমলেশ রায়ের পুত্র নিপুর রায় এর সাথে। তার দাদার বাবা ক্ষেত্রনাথ রায় ছিলেন ১৩ জমিদারের একজন। তার বড় বাবা ক্ষিতিশ রায় জমিদারির কিছুটা ভোগ করতে পারলেও তার বাবর জন্ম জমিদারির শেষ সময়ে। অন্যান্য জমিদাররা ভারতে চলে গেলেও তার পরিবার যায়নি। বংশধরদের মধ্যে যারা ভারতে চলে গিয়েছিলেন অধিকাংশরাই বাড়ির কাজের লোকদের বিশ্বাস করে সবকিছু আমানত রেখে যান। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন সব দখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি বাড়িতে এখনও ওইসব কাজের লোকের প্রজন্মরা বসবাস করছেন। আর কয়েকটি রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে।
নিপুর রায়ের বড় বাবার ব্যবহৃত ভবনটি এখনও তাদের দখলে থাকলেও নেই জমিদারির কোনো নিশানা। অভাবের তাড়নায় বিক্রি করে দিয়েছেন জমিদারদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র। কিছু জিনিসপত্র অনেক কষ্টে আঁকড়ে ধরে রাখলেও সময়ের ব্যবধানে সেগুলোও চুরি হয়ে গেছে।

গোবিন্দ চন্দ্র রায়ের বাড়িটি তফসিল অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। চিত্ত রঞ্জন রায়ের বাড়িটি স্থানীয় হাই স্কুলের নামে রেকর্ড হয়। আর জমিদার বনবিহারী রায়ের বাড়িটি বিক্রি করে দেন স্থানীয় মুসলিম পরিবারের কাছে।

জলসুখা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ফয়েজ আহমেদ (খেলু) জানান, জমিদাররা তাদের অধিকাংশ বাড়িই বিক্রি করে গেছেন। জমিদারদের বাড়ি কেউ দখল করছেন বলে আমার জানা নেই।

জলসুখা গ্রামের স্থানীয়রা জানান, ১৮ শতকের কোনো এক সময় জমিদার বৈকুণ্ঠ রায়ের বাবা দুলগোবিন্দ রায়ের বাড়িতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার মূল ভূমিকা পালনকারী লর্ড ক্লাইভ এসেছিলেন। এখানে এক রাত্রি যাপন করেছিলেন তিনি। তখনকার সময়েই তার আপ্যায়নে প্রচুর পরিমাণে টাকা ব্যয় করেছিলেন দুলগোবিন্দ রায়। জানা যায়, এই জমিদার বাড়িটিতে সে সময় ঘেটু নৃত্য পরিবেশিত হতো। পরে ওই বাড়িকে ঘিরে নির্মীত হয় হুমায়ুন আহমেদ এর ঘেটু পুত্র কমলা, নামের একটি সিনেমা। 

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও সাবেক উপ সচিব ড. শেখ ফজলে এলাহী জানান, জলসুখা এলাকায় ১৩ জন জমিদারের বাস ছিল এটা সঠিক। এর মধ্যে দুয়েকজন ছিলেন খুব প্রভাবশালী। জমিদার বৈকুণ্ঠ দাশের বাড়িতে শ্রীহট্ট সম্মিলনীর ৩য় অধিবেশন বসেছিল। এই সম্মিলনীতে প্রধান অতিথি ছিলেন ঋষি অরবিন্দ। 

তিনি আরো বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে জমিদারদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন স্থাপনা, পুকুর, খেলার মাঠ, মসজিদ, মন্দির ও বাড়িগুলোকে সংরক্ষণ করা হলে পুরোনো ঐতিহ্যটা থাকবে। স্থানীয় সচেতন মহলও জমিদারদের ব্যবহৃত ভবনগুলো সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা মুসলিম জমিদার পরিবারের বংশধর সানে আলম চৌধুরী বলেন, অনেকদিন আগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ জমিদার বাড়িগুলো দেখতে ভীড় করতেন পর্যটকরা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এগুলো একেবারেই অরক্ষিত হয়ে গেছে। তাই বাড়িগুলো দেখতে আর কেউ আসেন না। জমিদারদের বেশ কয়েকটি বাড়ি তারা বিক্রি করে গেছেন, কয়েকটি বাড়ি সরকারি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, আর কয়েকটি দখল হয়ে গেছে।

এ ব্যাপারে আজমিরীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুয়েল ভৌমিক বলেন, আমি এখানে যোগদান করেছি বিছুদিন হয়। বাড়িগুলো সম্পর্কে আমার খুব একটা জানা নেই। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরেজমিন পরিদর্শন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাবো। এছাড়া কেউ অবৈধ দখলে আছেন এমন কোন অভিযোগও কেউ করেন নি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত