রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:২০

আবদুল জব্বার

বিগত ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল সরকার বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পি.পি.এ) বাস্তবায়ন চুক্তি (আই এ), যৌথউদ্যোগ চুক্তির সম্পুরক (এসজেভিএ) স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি) ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর যৌথউদ্যোগে ভারত বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই মংলা সমুদ্র বন্দরের নিকটে রামপালে এক হাজার ৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করে বালু ভরাটের কাজ শুরু করা হয়।

এখানে বলা প্রয়োজন, এটি রামপালে ১ম পর্যায়ের কেন্দ্র। পরবর্তীতে রামপালে ২য় পর্যায়ে একই ক্ষমতার আরো একটি কেন্দ্র বসানো হবে। প্রকল্পটি একটি যৌথব্যবসার অধীনে সম্পাদিত হবে। ভারত সরকারের একটি সংস্থা হচ্ছে একপক্ষ, বাংলাদেশ সরকারের একটি সংস্থা হচ্ছে অন্যপক্ষ। যৌথব্যবসাটি হবে অবিকল কুমীর-শেয়ালের ব্যবসার গল্পের মতো। সকল রকম সুযোগ-সুবিধা ও লাভ যাবে চতুর শেয়ালের ভাগে আর যত আবর্জনা, অসুবিধা ও লোকসানের অংশ যাবে বোকা কুমীরের ভাগে। এই প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশের পরিবেশবিদরা ৩টি গুরুতর সমস্যা শনাক্ত করেছেন। প্রথমত হলো, চুক্তি অসম ও অস্বচ্ছ। দ্বিতীয়ত, এই প্রকল্পের জন্য যে স্থান নির্বাচন করা হয়েছে তাতে বাংলাদেশ ও বিশ্বের অমূল্য সম্পদ সুন্দরবন ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে। আর তৃতীয়ত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম থেকেই বিভিন্ন রকম অনিয়মত, নিপীড়ন শুরু হয়েছে। প্রয়োজনীয় সমীক্ষার শর্ত পূরণ না করেই জমি অধিগ্রহণ করে গোটা অঞ্চলের সন্ত্রাসী ও পুলিশ দিয়ে জোরপূর্বক গরিব মানুষদের বসতবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, এই প্রকল্প যদি দেশবাসীর উন্নয়নের স্বার্থেই করা হবে তাহলে এত অনিয়ম, হুমকি, জোর জুলুম, অস্বচ্ছতা আর গোপনীয়তা কেন?

বাংলাদেশের মত সাম্রাজ্যবাদ অধ্যুষিত দেশে একটি বৃহৎ প্রকল্প সাম্রাজ্যবাদের দেশীয় সহযোগী শোষক ধনিক শ্রেণীর ক্ষমতাসীন অংশের পক্ষে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ করে দিবে। পক্ষান্তরে দেশের শোষিত বিপুল সংখ্যক মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির দিকে ঠেলে দিবে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আন্তর্জাতিক লুটেরাদের অংশীদার দেশীয় সহযোগী দুর্নীতিবাজ দুর্বৃত্ত লুটেরা শাসক শ্রেণীর দুঃশাসনের বিপর্যস্ত বাংলাদেশের উপর উদীয়মান আদিপত্যবাদী আঞ্চলিক বিশাল শক্তিমান প্রতিবেশী দেশ ভারতের বৃহৎ পুঁজি নিত্য নতুন আগ্রাসন চালাচ্ছে। এই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সেই আগ্রাসনের একটি নতুন ক্ষেত্র।

এখানে স্মরণযোগ্য, বিগত ২০০০ সালের প্রথম দিকে বিশ্ব সামাজ্রবাদের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে ও সহায়তায় মার্কিন কোম্পানি ইউনোক্যাল কর্তৃক বাংলাদেশে আবিষ্কৃত অতি সমৃদ্ধ বিবিয়ানা গ্যাস কূপটির উৎপাদন সর্বাংশে অতি সুলভ মূল্যে ভারতে রপ্তানি করার জন্য ষড়যন্ত্র হয়। একই কোম্পানি ইউনিক্যাল গ্যাস বহন করার জন্য ৫০০ মিলিমিটার ব্যাস বিশিস্ট ভারতের অংশে হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন স্থাপনার জন্য ঠিকাদার হিসেবে কাজও পায়। তবে বাংলাদেশের তেল-গ্যাস, জাতীয় কমিটির নের্তৃত্বে দেশের জনগনের আন্দোলন এই ষড়যন্ত্রটি ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়।

এরপর ২০০৫ সালে বাংলাদেশে হাজির হয় ভারতের বৃহৎ কোম্পানি টাটা। কাঁচা গ্যাস নিতে ব্যর্থ হয়ে ভারত সরকারের পক্ষে টাটা গ্যাস দিয়ে প্রস্তুতকৃত পণ্য সার, বিদ্যুৎ, স্টিল উৎপাদন করে তার বড় অংশ ভারতে রপ্তানি করার পরিকল্পনা করে। তারা কয়েকটি প্রকল্প মিলে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের লোভ দেখায়। উল্লেখ্য, আমাদের দেশের গ্যাস শুদ্ধতায় শুধু উচ্চমানের নয় ব্যয়ও অত্যন্ত সুলভ, আন্তর্জাতিক মূল্যের এক পঞ্চমাংশ আমাদের দেশের শাসক গোষ্ঠীর দুর্নীতিসিক্ত আত্ম সমর্পন ও দেশের সাধারণ মানুষের অনুমতি অজ্ঞতা পুঁজি করে টাটা’র প্রাথমিক প্রস্তাব ছিল, হাজার ঘনফুটের মূল্য দেবেন ১.৫ মার্কিন ডলার, যেখানে এর আন্তর্জাতিক মূল্য ৮ ডলার। এক্ষেত্রেও তেল-গ্যাস, জাতীয় কমিটির আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে অন্তত ২০ বছর জুড়ে নিরবচ্ছিন্ন অবস্থায় সরবরাহের গ্যারান্টি দানের জন্য টাটার দাবি মানতে নতজানু অবস্থায় থেকেও টাটার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের মতো টাটা মাটি মানুষ ও পানি বিনাশী উন্মুক্ত খনি করতে চেয়েছিল বড় পুকরিয়ায়। জীবন দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ শুধু এশিয়া এনার্জিকেই তাড়ায়নি, টাটার আরেকটি বিধ্বংসী প্রস্তাবনাও ঠেকিয়েছে।

এসবের পর এখন এসেছে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প দু’টি। ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানি বা NTPC এই প্রকল্প দুটি নিয়ে, যার একটি বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় সুন্দরবনের অতি সন্নিকটে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমাদের দেশের গৌরব ও গর্ব বিশ্বঐতিহ্যের ধারক সুন্দরবনের বাংলাদেশের অংশ নিশ্চিতভাবে ধ্বংস করবে। এরপর সুন্দরবন বলতে বোঝাবে বর্তমান ভারতের অংশের সুন্দরবন। ক্রমান্বয়ে এটিও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সে জন্য সুন্দরবন রক্ষায় ভারতের মানুষেরাও আমাদের দেশের জনগণের সাথে যোগ দেবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।

রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা অনুযায়ী বলা হয়েছে, প্রথম পর্যায়ের উৎপাদিত হবে ১৩২০ মেগাওয়াট। দ্বিতীয় পর্যায়ে উৎপাদিত হবে ১৩২০ মেগাওয়াট। দুই পর্যায়ে ২৬৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭০ ভাগ অর্থ আসবে বিদেশী ঋণ থেকে। অবশিষ্ট ৩০ ভাগের মধ্যে ভারত বহন করবে ১৫ ভাগ আর বাংলাদেশ বহন করবে ১৫ ভাগ। আর ৭০ ভাগ ঋণের সুদসহ ঋণ পরিশোধ করার দায়দায়িত্ব বাংলাদেশের। অর্থাৎ ভারতের বিনিয়োগ মাত্র ১৫ ভাগ। কিন্তু তারা মালিকানা পাবে ৫০ ভাগ, কর্তৃত্ব প্রায় পুরোটাই। চুক্তি অনুযায়ী কয়লা আমদানির দায়দায়িত্বও বাংলাদেশের কাঁধে।

সময় মতো কয়লা না পাওয়া কিংবা অন্য কোন কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিছুদিন বন্ধ থাকলে সেজন্য ক্ষতির দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে বাংলাদেশকেই। এছাড়াও দুই পক্ষের মধ্যে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য কত হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত হয়নি, ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশের গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুতের মূল্যের চাইতে কমপক্ষে চারগুন বেশি হবে।

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে সাপমারী ও কৈগরদাসকাঠী মৌজায় মোট ৮টি ইউনিয়নের সর্বমোট ৪০টি গ্রামের কমপক্ষে ২ হাজার পরিবার ইতোমধ্যেই মারাত্বক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পরিবেশতগত ছাড়পত্র বা পরিবেশগত সমীক্ষা (ইআইএ) অনুমোদন হওয়ার আগে থেকেই এলাকায় জোরপূর্বক উচ্ছেদ অভিযান ও নির্যাতন চলেছে। আনসার ও পুলিশের সহায়তায় সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে অধিবাসীদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের ফলে এলাকার বহু কৃষক জমি হারিয়ে দিন মজুর শ্রমিকে পরিণত হয়েছেন। কৃষি মজুররা কাজের অভাবে অত্যন্ত মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। অথচ এই প্রকল্প নিয়ে এলাকার অধিবাসীরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের উদ্বেগ ও আপত্তি জানিয়ে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সরকার সে আবেদন কোনো আমলে নেননি। একটি ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পর্যায়ে ৪ হাজার এবং পরিচালনা পর্যায়ে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৬শত মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে। অন্যদিকে প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ১ম পর্যায়ে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১ হাজার ৮৩৪ একর জমি বেছে নেওয়া হয়েছে, যার বেশির ভাগই হলো কৃষি জমি। এই জমির মালিকও কৃষিকাজের উপর বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল মানুষের জীবন-জীবিকার কী হবে? রামপাল কৃষি জমি রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ শুরু থেকেই হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করে কৃষি জমির উপর এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের বিরোধীতা করে আসছেন।

সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ বিষয় নিয়ে দেশ বিদেশের পরিবেশ বিজ্ঞানী ও মানবাধিকার সংগঠন সুন্দরবনের অস্তিত্ব নিয়ে ইতোমধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। বিগত ২০১১ সালের ৫ মে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. আবদুস সাত্তার মন্ডলের নেতৃত্বে পরিবেশবিদদের একটি দল রামপালের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জায়গা পরিদর্শন করেন। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের মারাত্বক ক্ষতিসহ ২৩ ধরনের ক্ষতির হিসেব তুলে ধরেছিলেন। বিস্তৃত বিশ্লেষণে যে সমস্ত বিষয়ে তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো হলো, ১. রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে সুন্দরবনের স্বাভাবিক চরিত্র বিনষ্ট হবে, তৈরী হবে অসংখ্য কয়লা ডিপো, শুরু হবে গাছ কাটা, বনে আগুন লাগানো, বাঘ, হরিণ, কুমির ধরা। ২. কয়লা পোড়া সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি সুন্দরবনের জৈবিক পরিবেশ ও বায়ু মন্ডলকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। ৩. বায়ুমন্ডলের সালফার ড্রাই-অক্সাইড ও কার্বন যোগ্যসমূহ থেকে সৃষ্ট গ্রিনহাউজ গ্যাস বহনের জন্য অতি মারাত্বক ক্ষতিকর এসিড বৃষ্টি ঘটাবে। ৪. ওই অঞ্চল এবং আশেপাশের কৃষি জমিতে উৎপাদিত কৃষি পণ্য খেলে মানব দেহে ছড়িয়ে পড়বে অ্যাজমা, ফুসফুসবাহিত নানারোগ, এমনকি মরনব্যাধি রোগ ক্যান্সারের সম্ভাবনাও থাকবে। এছাড়াও কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টারবাইন, কম্প্রেসার, পাম্প, কুলিং টাওয়ার কনস্ট্রাকশনের যন্ত্রপাতি, পরিবহনের যানবাহনের মাধ্যমে ব্যাপক শব্দদূষণ ঘটবে। এ সমস্ত কারণেই আবাসিক এলাকা, কৃষিজমি এবং বনাঞ্চলের আশেপাশে কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার অনুমতি প্রদান করা হয় না।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী ‘রামপাল কয়লা ভিত্তিক প্রকল্পের সুন্দরবন ও পার্শ্ববর্তী এলাকার উপর পরিবেশের অভাব’ শীর্ষক প্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন, সুন্দরবন পৃথিবীর মধ্যে একক ম্যানগ্রোভ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জোয়ার-ভাটা খেলার বৈশিষ্টযুক্ত ছোট-বড় বহু শাখা-প্রশাখা বিশিস্ট নদী খাল দিয়ে, বিভক্ত দ্বীপমন্ডলীর সমষ্টি সুন্দরবন। এই বনাঞ্চলের মোট এলাকা ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার বা ২ হাজার ৩ শত বর্গমাইল। যার মধ্যে ম্যানগ্রভ এলাকা ৩ হাজার ৯ শত ৫৬ বর্গ কিলোমিটার বা ১ হাজার ৫ শত বা ২৭ বর্গ মাইল। এই জোয়ার ভাটার প্লাবিত বনাঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্পদে ও বৈচিত্রে সমৃদ্ধ। এই বনে রয়েছে ৬৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২০০ প্রজাতির মৎস্য, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জন্তু, ২৩৪ প্রজাতির পাখি, ৫১ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং অসংখ্য অমেরুদণ্ডী জীব। এ অঞ্চলের ৫ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবিকার জন্য সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। প্রবন্ধের উপসংহারে ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেছেন, অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় সামাজিক-প্রাকৃতিক পরিবেশ বিবেচনায়, কোনোভাবেই কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য রামপাল এলাকাকে সমর্থন করা যায় না।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন এখন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এ আন্দোলনে শুধু বাংলাদেশের সচেতন মানুষই নয় যোগ দিয়েছেন, দিচ্ছেন পার্শ্ববর্তী ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নানা জাতি, ধর্ম ও বর্ণের অসংখ্য মানুষ।

এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, সুন্দরবনের সন্নিকটে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিকল্প কি কোনো পথ নেই? দেশের পরিবেশবিদরাসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পৃথিবীর দেশগুলো এখন এগুচ্ছে পরিবেশ বান্ধব ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে। এর মধ্যে সূর্য, বাতাস, বর্জ ও পানি অন্যতম। আমাদের মত দেশগুলোতে সূর্য্য বা বাতাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের আলোচনা কমই হতো উৎপাদন খরচের কথা চিন্তা করে। তারপরও উচ্চ খরচে বাংলাদেশের ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ সোলার এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছেন। এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। সম্প্রতি বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম জানিয়েছে, ‘সৌর ও বায়ু শক্তির বিদ্যুৎ এখন ফুয়েল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এর সমান অথবা আরো কম দামে মিলবে’। তাদের দেওয়া তথ্যের সূত্রমতে বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির চাহিদা পূরণ সমান খরচে বা আরও কম মূল্যে সম্ভব হয়েছে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০ বছর আগেও সৌরশক্তি থেকে প্রতি মেগাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৬০০ মার্কিন ডলার খরচ পড়তো। কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ হতো ১০০ মার্কিন ডলার। এখন সৌরশক্তি থেকে প্রতি মেগাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ হচ্ছে ১০০ ডলার। আর বায়ু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ৫০ মার্কিন ডলার।

আমাদের দেশের জন্য এটি সুখবর। আমরা বছরে যে পরিমাণ সূর্য ও বায়ু ব্যবহার করে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিন্তা করতে পারি, পৃথিবীর কম দেশেই এটা সম্ভব হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এমনকি তেল সমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবেও সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় বড় পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ সব তথ্য উপাত্ত আমাদের বলে দেয় যে, সুন্দরবনের সন্নিকটে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।

আবদুল জব্বার

লেখক, বীরমুক্তিযোদ্ধা ও মানবাধিকারকর্মী

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত