তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব

প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:০৫

সাহস ডেস্ক

উপমহাদেশের অসামান্য দেশপ্রেমিক বাঙালি বীর স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন আজ। যিনি ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গড়ে তুলে ভারতবর্ষকে ইংরেজ উপনিবেশের নিগড় থেকে মুক্তির লড়াইয়ে নেমেছিলেন। আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে আসমুদ্রহিমাচল কাঁপিয়ে তুলে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ তার মুক্তিমন্ত্রে জেগে উঠেছিল সমগ্র উপমহাদেশ। কিন্তু ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অবাঙালি নেতাদের কারণে তিনি উপলব্ধি করেন, দেশে থেকে স্বাধীনতা আনা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি বিদেশে পাড়ি জমান।

তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ বাস্তববাদি এবং আজন্ম আশাবাদী একজন মানুষ। যে কারণে মোহনদাস গান্ধী, জওহরলাল নেহরুসহ অনেক অবাঙালি নেতার সঙ্গে তার মতের মিল ছিল না।

বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে ছিল তার সুস্পষ্ট ধারণা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, একটা বিশ্বযুদ্ধ এগিয়ে আসছে এবং এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজদের বিতাড়িত করতে হবে। কিন্তু তার সেই দূরদর্শী পরিকল্পনা অধিকাংশ অবাঙালি নেতা উপলব্ধি করতে পারেননি। তার বিদেশ গমন, আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে তোলা এবং উপমহাদেশকে স্বাধীন করতে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা আজো রূপকথার মত রোমাঞ্চিত করে আসমুদ্রহিমাচলের সমস্ত মানুষকে। তিনি আজো বাঙালির হৃদয়ে রূপকথার মহাবীরের মত। আজো বাংলার ঘরে ঘরে শোভা পায় তার ছবি।

ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতেই পাল্টে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিধারা। তার প্রধান সহায়ক শক্তি জাপান আত্মসমর্পণের তিন দিন পর সুভাষচন্দ্র ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানের তাইহোকুতে এক বিমান দুর্ঘটনায় তিনি নিহত বলে খবর প্রচারিত হয়। তবে এই বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক তদন্ত হয়েছে। অধিকাংশ তদন্তেই ওই দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যুর প্রমাণ মেলেনি। সর্বশেষ মুখার্জী অনুসন্ধান কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুভাষ বসু মারা গেছেন, তবে ঐ বিমান দুর্ঘটনায় নয়। তার রহস্যময় অন্তর্ধানের প্রায় ৬৮ বছর অতিক্রান্ত হলেও আজো কিনারা হয়নি।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন ইংরেজের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণময় ব্যক্তিত্ব। আজাদ হিন্দ ফৌজ লড়াইয়ে ইংরেজদের পরাজিত করতে পারেননি সত্যি তবে আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের বন্দি করে ইম্ফল থেকে ট্রেনে করে বিচারের জন্য নয়া দিল্লী নেয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে পাল্টে যায় উপমহাদেশের দৃশ্যপট। অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে গোটা উপমহাদেশ। ইংরেজরা স্বীকার করে, তারা জীবন্ত আগ্নেয়গিরির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যে জওহরলাল নেহরু একদিন তরবারি হাতে সুভাষ বসুকে প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনিও সেদিন বাধ্য হন আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের পক্ষে।

সুভাষচন্দ্রের জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি এখনকার উড়িষ্যা রাজ্যের কটক শহরে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার বারুইপুরের কাছে কোদালিয়া গ্রামে। ১৯১৯ সালে দর্শনে প্রথম শ্রেণিতে বিএ পাস করেন তিনি। এরপর বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ১৯২০ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসেন। এই পরীক্ষাতে চতুর্থ স্থান অধিকার করলেও, ১৯২১ সালে সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করেন এবং দেশে ফিরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অধীনে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে কলকাতা শহরের মেয়র হয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেয়ায়।

তাঁকে ইংরেজরা জেলে বন্দী করে। ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হন সুভাষ। কিন্তু গান্ধীজির সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সেই পদত্যাগ করেন। এরপর জওহরলাল নেহরুর সঙ্গেও তাঁর মতবিরোধ হয়। তখন কংগ্রেসের মধ্যেই তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি রাজনৈতিক উপদল তৈরি করেন। এরপরই ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গৃহবন্দী করে। ১৯৪১ সালের ২৬ জানুয়ারি সুভাষ বাড়ি থেকে অন্তর্হিত হন। বিদেশে গিয়ে ১৯৪২ সালের ২১ অক্টোবর নেতাজি ‘আর্জি-হুকুমত্-এ-আজাদ হিন্দ’ বা ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ ঘোষণা করেন। এই সরকার সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়। জাপানি বাহিনীর সহায়তায় আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারত অভিযান চালায়। মণিপুরের কোহিমা দখল করে স্বাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এই বাহিনী। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জও দখল করেছিলেন তারা। নেতাজি এই দ্বীপের নাম রেখেছিলেন ‘শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপপুঞ্জ’।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত