ঐতিহ্য হারাচ্ছে সাতক্ষীরার গুড়পুকুর মেলা

প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৫২

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি

সাতক্ষীরা শহরের ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী গুড়পুকুরের মেলাটির উৎপত্তি ও শুরু নিয়ে নানা মত রয়েছে। কথিত রয়েছে সাতক্ষীরার জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরীর পূর্ব পুরুষরা প্রজাদের প্রয়োজনে রাস্তাঘাট, পুকুর, দিঘি, স্কুল, মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।

সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোলে একটা বড় বটগাছ ছিল। সেখানে এক যুবককে সাপে কাটে। প্রায় মৃত অবস্থায় সে সময় প্রজারা বটতলায় মনসা পূজা করেন। তারপর সে সুস্থ হয়ে উঠে। এই মনসা পূজা থেকেই গুড় পুকুরের মেলার উৎপত্তি হয়। তবে এ মেলা এক সময় শহরের পলাশপোল চৌধুরী বাড়ি থেকে গুড় পুকুর হয়ে কদম তলা ইটাগাছা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু বর্তমানে মেলার পরিধি অনেক ছোট হয়ে আসছে।

জানা যায়, মনসা পূজাকে ঘিরে গুড় পুকুরের মেলা শুরু হতো। কিন্তু এবার ১৮ তারিখ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিতা কাটার মধ্যে দিয়ে ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী গুড় পুকুরের মেলা উদ্বোধন হয়। এক সময় বৃহত্তর পরিসরে উদযাপিত হলেও বর্তমানে এ মেলা ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর সেইভাবে মেলাটি পালিত হচ্ছে না। এখন শহরের পলাশপোলের মনসা তলা থেকে ১ কি.মি দূরে সরে গিয়ে শহরের রাজ্জাক পার্কে মেলাটি সীমিত আকারে হচ্ছে। ফিতা কাটা বা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই  যেন মেলাটি সীমাবদ্ধ।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল ওয়ারেশ খান চৌধুরী বলেন, প্রায় সাড়ে ৩ শত বছর ধরে চলা এই গুড় পুকুর মেলায় বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসতো। ফরিদপুর, বরিশাল, ইন্ডিয়ার বশিরহাট, এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এখানে ব্যবসা করতে আসতো। খাট, পালঙ্গ, দা, কুরাল, কাঁচ, ভিন্ন প্রকারের গাছ বিকি হতো মেলায়। আমরা ছোট বেলায় দেখেছি কদমতলা থেকে ইটাগাছা পর্যন্ত ব্যাপক লাইনে দোকান পাট বসতো। সেখানে মানুষ চলতে পারতো না, আর ছোট বাচ্চা তো সেখানে ঢুকতেই পারতো না। অথচ ২০০২ সালে হঠাৎ এ মেলাতে সার্কাস এবং রকসি সিনেমা হলের একটি জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। আর এতে ৩ জন মারা যান এবং শতাধিক নারী পুরুষ আহত হন। সেই থেকে মেলা কিছু দিন বন্ধ থাকার পর ২০০৯ সালে আবার চালু হয়। 

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও কবি নিমাঈ চন্দ্র মন্ডল বলেন, এই মেলার একটি অর্থনৈতিক তাৎপর্য ছিল। শুধু সাতক্ষীরা নয় বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে দা, কুরাল, বটি এবং বিভিন্ন লোহার তৈরি যন্ত্রপাতি তারা বিক্রয় করতো এবং ফার্নিচারের ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। এতে করে প্রায় দুই তিন মাস থেকে চার পাঁচ মাসের কর্মসংস্থান হতো এই সব পেশাজীবি মানুষের। আজকে সেই মেলা ফুরিয়ে গেছে। আগের মতো সেই মেলা এখন আর হয় না।

জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য অ্যাড ফাইমুল হক কিসলু বলেন, মেলাটাকে সেই পূর্বের উৎসবে নিয়ে আসতে হলে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক উদ্যোগকে বেশি করে গুরুত্ব দিতে হবে। সম্মিলিতভাবে সবাই মিলে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মেলাকে আমরা আগের অবস্থানে ফিরে আনতে চাই। এইটা যদি সবাই মিলে করতে পারি। তাহলে আমরা আগের অবস্থানে ফিরে আসতে পারবো।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মেরিনা আক্তার বলেন, গুড় পুকুর মেলা উপলক্ষে আমাদের সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সুপার বিভিন্ন ধরণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছেন। আমাদের পুলিশ সুপার স্যারের দিক নিদের্শনায় আমরা তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি। এটি এই জেলার একটা ঐতিহ্যবাহী মেলা। এখানে প্রত্যেক জেলা থেকে লোকজন আসে দোকান পাট দেওয়ার জন্য। সেই সকল ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে আমরা তথ্য নিয়েছি এবং আমাদের যে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে সেখানে আমাদের সাদা পুলিশের একটা টিম থাকবে, একটি মোবাইল টিম ও স্টাটিকস টিম থাকবে। আমরা চেষ্টা করবো ঐতিহ্যবাহী এই মেলা যেন সফলভাবে শেষ হয়।

সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়র মো. তাজকিন আহমেদ চিশতি বলেন, গুড় পুকুরের মেলা সাতক্ষীরার শত বছরের প্রচীনতম ঐতিহ্য। সাতক্ষীরা সদরের ১৪টি ইউনিয়ন ও ৭টি থানার মানুষের উৎসব মুখুর পরিবেশে মধ্যে দিয়ে এই মেলায় সমাগম হয়। মূলত ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে মনসা পূজার মাধ্যমে জমিদার প্রাণ নাথ বাবু এই মেলাটি উদ্বোধন করেছিলেন। সেখান থেকে আজও চালু রয়েছে। পূর্বে যে উৎসব মুখর পরিবেশে মেলাটি হতো আমরা সেটার গতি প্রকৃতি ফিরিয়ে আনার  জন্য চেষ্টা করছি।

১৮ সেপ্টেম্বর মনসা পূজার মাধ্যমে এই মেলার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। মেলার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি আমরা কাজ করছি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল মানুষ যাতে মেলাটি উপভোগ করতে পারে সে জন্য আমরা এই মেলাকে আরও বেশি বড় আকারে করতে চাই।

প্রসঙ্গত, জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার যৌথ আয়োজনে শহরের আব্দুর রাজ্জাকপার্কে মাস ব্যাপী এ মেলা চলবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত