গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে আর হেলাফেলা নয়
প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:১১
আপনার বাড়িকে সুরক্ষিত করার জন্য টেকশই দরজা-জানালা বা লোহার গ্রিল লাগানো ছাড়াও আরো অনেক কিছু করার থাকে। কারণ, বিপদ কখনো বলে আসে না। তাই নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগ বা তারের লাইনগুলো নিয়মিত দেখাশোনা করার দরকার রয়েছে।
একটি বিষয় খুব সর্তক থাকতে হবে। সেটা হলো গ্যাস সিলিন্ডার। এটি কেবল আপনার রান্নাঘরের কাজকে সুবিধাজনক করে তোলে না, এটি প্রায় সবসময় আপনার পাশে থাকা জীবন্ত বোমাও। তাই এই গ্যাস সিলিন্ডার থেকে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
গ্যাস সিলিন্ডার
লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এল পি জি অথবা এল পি গ্যাস) অর্থাৎ চাপে শীতলীকৃত জ্বালানী গ্যাস, এ সমস্ত নামে প্রোপেন বা বিউটেনকে বা এদের মিশ্রণকেও নির্দেশ করা হয়। এটি মূলত দাহ্য হাইড্রোকার্বন গ্যাসের মিশ্রণ এবং জ্বালানী হিসেবে রন্ধন কার্যে, গাড়িতে ও ভবনের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে (HVAC) ব্যবহৃত হয়।
যেহেতু সিলিন্ডারের গ্যাস খুব বেশি চাপে তরল করে প্রবেশ করানো হয়, তাই এটির বিস্ফোরণও খুব মারাত্মক হয়। এর বিস্ফোরণ হলে শক ওয়েভ ছড়িয়ে পড়ে। এ শক ওয়েভ শরীরের যে অংশে লাগে, সে অংশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। অনেক সময় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফুসফুস। ফুসফুসে রক্ত জমা হতে পারে, সম্পূর্ণ ফুসফুস ছিন্নভিন্ন হতে পারে। এতো বেশি শক্তি উৎপন্ন হয় যে সেই সময় আশেপাশে থাকা মানুষদের অনেকদূরে ছিটকে ফেলতে পারে।
গ্যাস সিলিন্ডার স্থাপন
নতুন সিলিন্ডার নির্দিষ্ট স্থানে রাখার আগে অবশ্যই কিছু বিষয় পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। সিলিন্ডারের মুখে কাগজে মোড়ানো সিল আছে কি না। সিল থাকে মানে হচ্ছে ভেতরে গ্যাস পরিপূর্ণ আছে। এবার সিল সরিয়ে প্রেশার রেগুলেটরের ওপর সংযোগ ক্লিপ লাগাতে হবে। এরপর সুইচ অন করে দেখে নিতে হবে ক্লিপের সঙ্গে রেগুলেটর ঠিকভাবে আছে কি না।
গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের নিয়ম বা শর্ত
গ্যাস সিলিন্ডার প্রায় সব রকম শিল্প এবং জায়গায় নিয়মিত ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কেননা এর সুবিধা ও কার্যকারিতা অন্যান্য বিকল্পগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। তাই সিলিন্ডার ব্যবহারের সময় আপনাকে কিছু নিয়মাবলী মানতে হবে।
১/ সিরিন্ডার সবসময় ছায়া যুক্ত ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে, যেন তাপের সংস্পর্শে না আসে।
২/ গ্যাস সিলিন্ডার পরিবর্তনের সময় অবশ্যই ফ্লেম বন্ধ রাখুন।
৩/ গ্যাসের পাইপ যথা সময়ে পাল্টানো দরকার। জোড়াতালি দিয়ে ব্যবহার না করাই ভালো। পাইপ কেটে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা বদলে ফেলুন।
৪/ রান্না ঘরের মধ্যে কোন প্রকার দাহ্য পদার্থ রাখবেন না। প্লাস্টিক, কাগজ, কেরোসিন ও গ্যাস ভর্তি অন্য সিলিন্ডার রাখবেন না।
৫/ এলপিজি সিলিন্ডার যদি অব্যবহৃত থাকে অথবা গ্যাসহীন অবস্থায় থাকে, তাহলে রেগুলেটরের নব বন্ধ করে রাখতে হবে।
৬/ সিলিন্ডারের জন্য সব সময় গুণগতমানের টিউব, রেগুলেটরসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে হবে।
৭/ সিলিন্ডার ভর্তি থাকার সময় সেফটি ক্যাপ ব্যবহার করা উচিত।
৮/ স্টোভ অথবা সিলিন্ডারে কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানের পরামর্শ নিতে হবে।
৯/ অনুমোদিত ডিলার বা সরবরাহকারীর কাছ থেকে এলপিজি সিলিন্ডার কিনতে হবে।
গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের সময় যা করবেন না
১/ সিলিন্ডারের আশেপাশে কখনো মোবাইল ফোন, ক্যামেরা ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করা যাবে না।
২/ একটি সিলিন্ডার থেকে একাধিক সংযোগ দেওয়া যাবে না।
৩/ গরম টিউব ব্যবহার করা যাবে না। টিউব গরম হলে সেটা দ্রুত পরিবর্তন করতে হবে।
৪/ সিলিন্ডার ও চুলার সংযোগে পাইপের সঙ্গে কোনো কিছু প্যাঁচানো যাবে না্।
৫/ কোনো অবস্থায় সিলিন্ডার বাঁকা বা শুইয়ে রাখা যাবে না।
৬/ টিউব, রেগুলেটর কিংবা অন্য কোনো অংশ লিকেজ হয়েছে কি না, তা চেক করতে কখনো দেশলাইয়ের কাঠি বা লাইটার অথবা আগুন জ্বালানো যাবে না।
৭/ নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
গ্যাস লিক হলে যা করণীয়
যদি কখনো গ্যাস লিকের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন তাহলে যা করবেন-
১/ দ্রুত চুলা ও সিলিন্ডারের রেগুলেটরের সুইচ বন্ধ করে দিয়ে তৎক্ষণাৎ সেফটি ক্যাপ লাগিয়ে দিতে হবে।
২/ অনাকাঙ্ক্ষিত আগুনের সূত্রপাত হলে তা নিভিয়ে ফেলতে হবে।
৩/ সব ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী বন্ধ করে ফেলুন এবং যেকোন ধরণের শিখা, লাইট, ধূপ কাঠি, মোমবাতি ইত্যাদি নিভিয়ে ফেলুন।
৪/ যে কোনো আগুন জ্বালানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫/ পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুত বাসার বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দিতে হবে এবং কাছের গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অথবা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিতে
৬/ বাতাস ভালোভাবে চলাফেরা করার জন্য প্রত্যেকটি জানালা ও দরজা খুলে দিন, কিন্তু সব গুলো ফ্যান বন্ধ করে রাখুন।
৭/ এছাড়া ফায়ার সার্ভিস ও পার্শ্ববর্তী থানার সাথে যোগাযোগ করুন অথবা ৯১১ এ ডায়াল করুন।
সার্টিফাইড কোম্পানি থেকে অনুমোদিত সিলিন্ডার কিনুন
গ্যাস সিলিন্ডার শুধু বাসাবাড়িতে কিংবা হোটেল-রেস্তোরাঁয় রান্নার কাজে নয়, বর্তমানে যানবাহনেও ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই এটি সব সময় অনুমোদিত বিক্রেতাদের কাছ থেকে নেওয়া উচিত। সিলিন্ডারগুলো সার্টিফাইড কোম্পানি থেকে তৈরি হয়েছে কি না সেই বিষয়টাও খেয়াল রাখতে হবে। সেজন্য সিলিন্ডার কেনার সময় কিছু বিষয় নিশ্চিত করে নিবেন।
১/ বিক্রেতা কিংবা ডেলিভারি ম্যানকে সিলিন্ডারের যথাযথ ব্যবহার বিধি ও ম্যানুয়াল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে দ্বিধা করবেন না।
২/ সিলিন্ডারটি টানা হেঁচড়া বা মাটিতে গড়াবেন না কিংবা ফেলে দেবেন না। এগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিশেষজ্ঞরা বিশেষ ভাবে নিষেধ করে থাকেন।
৩/ নিশ্চিত করুন সিলিন্ডারে কোম্পানির সিল রয়েছে কি না।
৪/ ভূমির সমতলে সমান ও শুষ্ক জায়গায় সিলিন্ডারটি রাখুন।
৫/ নিশ্চিত করুন যে সিলিন্ডারটির সেফটি ক্যাপটি সুরক্ষিত ভাবে লাগানো রয়েছে কি না
।
কমার্শিয়ালে ব্যবহারের ক্ষেত্রে করণীয়
কমার্শিয়াল কিংবা শিল্পক্ষেত্র, যেমন- হোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি জায়গায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে কড়া নিয়ম কানুন মেনে চলা উচিত।
১/ যেকোন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অ্যালার্ম ব্যবহার করে সকলকে জানানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
২/ সিলিন্ডার রয়েছে এমন জায়গায় সব অপেশাদার মানুষের প্রবেশ ও যাতায়াত সীমাবদ্ধ করে দিতে হবে।
৩/ স্টোরেজ কিংবা সিলিন্ডার আছে এমন জায়গায় কোন ভাবেই ধূমপান করতে দেয়া যাবে না।
৪/ লিক হওয়ার ঘটনায় দ্রুত পুরো ভবন খালি করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫/ আগুন লাগার ঘটনায় অগ্নি নির্বাপক ব্যবহার করুন এবং ফায়ার সার্ভিসে খবর দিন।
৬/ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তৎক্ষণাৎ ইমারজেন্সি সার্ভিসকে জানাতে কোনরকম দ্বিধা করবেন না।
বাংলাদেশে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার প্রচুর বেড়ে যাওয়ায় যেকোন দুর্ঘটনাই প্রাণঘাতী হয়ে উঠে। তাই ঠিক সময়ে যথাযথ নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নেওয়া না হলে, যেকোন বড় দুর্ঘটনার আকার ধারণ করতে যেতে পারে।
সাহস২৪.কম/ইতু/রিয়াজ